শিশু তো মা দুর্গার হাতে তিনটে ত্রিশূল ধরিয়ে দিতে পেরেছে, তবে অন্যায় রোধের সেই সম্মিলিত ত্রিফলা কি আদৌ আমাদের হাতে আছে? একটা ছবি। শিশুমনের এক কল্পনা। ক্রমাগত তুলে ধরছে আমাদেরই ছেঁড়াফাটা তালি মারা আকাশটিকে।
‘কী ছবি আঁকছ তুমি?’
একমনে বসে ছবি আঁকছিল খুদেটি। সাদা কাগজের উপর লাল কালিতে ফুটিয়ে তুলছিল সময়ের ক্ষত। প্রতিবাদের ঢেউ তখন আছড়ে পড়ছে অ্যাকাডেমি চত্বরে। রং-তুলি যেন আগুনের ভাষা হয়ে চিনিয়ে দিচ্ছে শহর কলকাতার রাগ-ক্ষোভ-দ্রোহ। গোটা চত্বর জুড়েই শিল্পীরা এঁকে দিচ্ছেন তাঁদের প্রতিবাদ। গান-কবিতা বক্তব্যে জোরাল হচ্ছে বিচারের বাণী। আর তার ভিতরই বসে একমনে এঁকে চলেছিল খুদেটি।
আরও শুনুন:
প্রশ্ন শুনে অবশ্য মুখ তুলল না খুদে শিল্পী। প্রথমে শেষ করল তার শিল্পকর্ম। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শক দেখল, মা দুর্গার চোখে জলের ফোঁটা এঁকে দিয়েছে একরত্তি। মা দুর্গা কাঁদছেন। হয়তো সত্যিই তা-ই। শারদবেলা তো আসন্নপ্রায়। এই সময় বাঙালির মন পুজো পুজো করে ওঠে। প্রকৃতিও উজাড় করে দেয় শরৎআলো। এই বছরটা যেন আচমকাই হারিয়ে ফেলেছে সেই আলোটুকু। যে ভয়াবহ অন্ধকার, যে মর্মান্তিক বিপন্নতা চেপে বসেছে শহরের বুকে, সেই ক্ষত থেকে তাই অবিরত রক্তক্ষরণ। স্বস্তি পাচ্ছেন না কেউ-ই! প্রতিদিন চাইছেন, যে নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছেন তিলোত্তমা, তার প্রতিকার হোক। দোষীরা শাস্তি পাক! তবু আইন! তদন্ত! তবুও নিয়মাফিক কার্যাবলি! সে যেন বহুদূরের পথ! আর সেদিকে তাকিয়ে ক্রমাগত দীর্ঘশ্বাস। এই শহরের রাজপথে, এই বাংলার পথে সেই দীর্ঘশ্বাস কখনও বেজে উঠছে স্লোগান হয়ে। কখনও চিত্রিত হচ্ছে গ্রাফিতিতে। সময়ের বুকে দলা পাকিয়ে আছে কান্না। তাহলে মা দুর্গা কি কাঁদবেন না? তিনি তো এই বাংলারই ঘরের মেয়ে। বাঙালিরা সেভাবেই তাঁকে কল্পনা করেছেন। তিনি অসুরনাশিনী, অশুভ বিনাশিনী। বাঙালির কাছে তাঁর সেই রূপ। সেই তিনিও যেন আজ চোখের জল গোপন করতে পারছেন না।
একমনে আঁকছিল খুদে। মা দুর্গা হলেন ষড়ভুজা। প্রথমে তিনটি হাত আঁকা হল। সেই তিন হাতে উঠে এল অস্ত্র। এবার বাকি তিন হাত। আর সেই তিন হাতে তিনি ধরলেন তিনটি ত্রিশূল। তীক্ষ্ণ ফলায় তিন হাতের তিন ত্রিশূলে তিনি একে এক বিদ্ধ করলেন তিন অসুরকে। এতক্ষণে শেষ হল খুদে শিল্পীর ছবি। অসুরবধ যখন সম্পন্ন। খুদে এবার জবাব দিয়ে শুধু বলল, ‘তিনটে অসুর…’।
খুদের এ-ছবি যেন আমাদের ক্রমাগত বিপন্ন করে। কে তাকে এই ছবি আঁকতে শেখাল? হয়তো তার মা। কিংবা এই সময়। যে সময় মা দুর্গার তিন হাতেই ত্রিশূল তুলে দিয়েছে। যে সময়ে মা দুর্গাকে একসঙ্গে বধ করতে হয় তিনজন অসুরকে (প্রচলিত অর্থেই)। এ বড় সুখের সময় তো নয়! আর এই গভীর গভীরতর অসুখের দিনে শিশুমনও দেবীকে কল্পনা করেছে একেবারে অন্য রূপে। তিনি কাঁদছেন, আবার অশুভ শক্তিকে বিনাশও করছেন। ঠিক যেন এই সময়টারই প্রতিরূপ। মর্মান্তিক বিয়োগব্যথায় সে কাঁদছে, আবার অশুভকে নাশ করতে পথে নামতে কি রাতের দখল নিতেও কসুর করছে না।
আরও শুনুন:
রাতের পথে কেবল ধর্ষকের অধিকার নাকি! বহু আগেই শুরু ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ আন্দোলনের
সময়ের দুর্বিষহ ক্ষত শিশুমনে যে ছাপ ফেলল, তাই তো উঠে এল তার খাতায়। প্রতিবাদ রাজনৈতিক নাকি অরাজনৈতিক, তা নিয়ে দিকে দিকে এলিট তর্ক। কার প্রতিবাদ কতখানি সাচ্চা তাও যেন গঙ্গাজলে ধুয়ে মিলিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আর তার ভিতর বসে থেকে থেকে ফিরে আসে ওই শিশুমনের কল্পনা। শারদছবি বদলে গিয়েছে যার কাছে। এই ছবি যেন সকলের কাছেই প্রশ্ন তুলছে, অহেতুক তর্ক বিবাদ, অমূলক মন কষাকষি করে এই বাস্তবতাকেই কি কোথাও অস্বীকার করা হচ্ছে না? যে বাস্তবতা এমন ছবির জন্ম দেয়, তা মুছে ফেলার জন্য নাগরিকরা প্রত্যেকে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন তো? শিশু তো মা দুর্গার হাতে তিনটে ত্রিশূল ধরিয়ে দিতে পেরেছে, তবে অন্যায় রোধের সেই সম্মিলিত ত্রিফলা কি আদৌ আমাদের হাতে আছে? একটা ছবি। শিশুমনের এক কল্পনা। ক্রমাগত তুলে ধরছে আমাদেরই ছেঁড়াফাটা তালি মারা আকাশটিকে।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা এই শিশুকে সুসময় উপহার দিতে পারিনি। আমাদের সৌভাগ্য যে, দুঃসময়কে প্রতিবাদের ভাষায় অনুবাদ করতে শিখে নিচ্ছে একটি শিশুও। এইটিই বোধহয় এই সময়ের সবথেকে বড় অবদান।