হাসপাতালের ভিতরেই তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন। বেনজির ঘটনায় তোলপাড় দেশ। কিন্তু সত্যিই কি বেনজির? হাসপাতালের ভিতরে মহিলা চিকিৎসাকর্মীরা কি আদৌ নিরাপদ ছিলেন আগেও? কলকাতার বিপন্নতা মনে করিয়ে দিচ্ছে অরুণা শানবাগের কথা।
কর্মক্ষেত্রকে বাড়ির বাইরে আরও একটা বাড়ি বলেই মনে করি আমরা। সেখানেও মেয়েরা নিজেদের নিরাপদ বলে ভাবতে পারবেন না? প্রশ্ন তুলছে আর জি কর হাসপাতালের নৃশংস কাণ্ড। চিকিৎসক, নার্স, সেবাকর্মী সকলের জীবনেই রাতের ডিউটি একেবারে স্বাভাবিক রুটিন। গোটা রাত হাসপাতালে ছুটোছুটি করা, রোগীর দেখভাল করা, প্রয়োজনে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে যাওয়া আসা, তার ফাঁকে সুযোগ পেলে সামান্য বিশ্রাম- এ সবকিছুই চিকিৎসাকর্মীর জীবনে আদ্যন্ত স্বাভাবিক। সেখানে তিনি পুরুষ না নারী, তা নিয়ে মাথাই ঘামানোর কথা নয়। আর যে জায়গাটাকে দিনেরাতে সচল রাখেন তাঁরাই, সেখানে তাঁরাই আক্রান্ত হতে পারেন- এমনটা কি ভাবা যায়? অথচ বাস্তবে সেটাই ঘটেছে। নিজের হাসপাতালেই ভয়ংকর নির্যাতনের পর খুন হয়ে গিয়েছেন এক চিকিৎসক, যিনি লিঙ্গপরিচয়ে মহিলা।
আরও শুনুন:
নির্যাতনের দামে কেনা, তাই খোলা আকাশের অধিকার মেয়েদেরও
এ ঘটনাকে বেনজির বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু কলকাতার এ ঘটনা কি অরুণা শানবাগকেও মনে করিয়ে দিচ্ছে না? আর সেখান থেকেই প্রশ্ন উঠছে, আদৌ কি নিরাপদ ছিলেন চিকিৎসাকর্মী মেয়েরা? অতীতে, বর্তমানে, নিজেদের কাজের জায়গাতেই সম্পূর্ণ নিরাপত্তা কি ছিল তাঁদের? নাকি চিকিৎসাকর্মীর থেকে নারীর লিঙ্গপরিচয় আর শরীরটাই ছিল সকলের নিশানায়?
১৯৭৩-এর ২৭ নভেম্বর, হাসপাতালের ভিতরেই ধর্ষিতা হয়েছিলেন অরুণা রামচন্দ্র শানবাগ। নার্সিং ট্রেনিং নিতে কর্নাটকের হলদিপুর থেকে মুম্বইয়ের পারেলে গিয়েছিলেন অরুণা। কিং এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হাসপাতালে। সেখানকারই একজন চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথাও ততদিনে পাকা। কিন্তু হাসাপাতালের মধ্যেই একটা রাত অরুণার গোটা জীবনটা দুরমুশ করে চলে গিয়েছিল। তিনি যখন পোশাক বদলাচ্ছিলেন, তখনই আচমকা অরুণার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়ার্ড-বয় সোহনলাল ভরত বাল্মীকী। কুকুর বাঁধার চেন দিয়ে অরুণার গলা বেঁধে ফেলে তাঁকে ধর্ষণ করে সে। পরের দিন সকালে যখন অরুণাকে উদ্ধার করা হয়, তখন তিনি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মাটিতে পড়ে, মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্তে। কুকুর বাঁধার চেন এত জোরে চেপে বসেছিল অরুণার গলা ও ঘাড়ে যে, ৮ ঘণ্টার জন্য তাঁর মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছতে পারেনি। তার পরেই কোমায় চলে যান অরুণা। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত, টানা ৪২টা বছর, হাসপাতালের বেডে সেইভাবেই জীবন্মৃত হয়ে ‘বেঁচে’ ছিলেন অরুণা শানবাগ।
আর সেই ধর্ষক? সে পরে অভিযুক্ত হয় চুরি ও নির্যাতনের অভিযোগে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল না। ফলে দুবার ৭ বছর করে জেল খেটেই সে ছাড়াও পেয়ে যায়।
আরও শুনুন:
আঁচল সরলেই ‘মন্দ মেয়ে’র উপাখ্যান! যেন প্রাচীন মুদ্রাদোষ
অরুণা শানবাগ হারিয়ে গিয়েছেন। তবুও হাসপাতালের ভিতরেও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার হয়নি। তা নিয়ে দাবি ওঠেনি। এবার হারিয়ে গেলেন আরও এক মেয়েও। আর কতবার, প্রত্যেকটি আলাদা ঘটনাকে বেনজির বলে এই ধারাবাহিক ধর্ষণ সংস্কৃতিকে এড়িয়ে যাব আমরা?