কঙ্গনা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, বিনেশকে কত কত সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তিনি শাসকদলের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও। তার পর ঘটনা যেদিকে গড়াল, বিনেশ যেভাবে দেশের হৃদয়ে থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পৌঁছে গেলেন, তাতে সে কথাগুলো নেহাতই ঠুনকো হয়ে রয়ে গেল! পদক হারালেও, দেশবাসীর চোখে হিরো হয়ে গিয়েছেন বিনেশ। লিখলেন সরোজ দরবার।
কঙ্গনা রানাউত,
বিনেশ ফোগতের আস্পর্ধা একবার ভাবুন! বলা নেই কওয়া নেই যৌন হেনস্তার অভিযোগে একেবারে রাস্তায় নেমে পড়লেন। তাও আবার প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে। তিনি তো বিজেপি দলেরই নেতা। যে দলের হয়ে টিকিট পেয়ে আপনি এখন আলো করে আছেন সংসদ। বিনেশের আরও আস্পর্ধা দেখুন। খোদ প্রধানমন্ত্রীর নামে স্লোগান দিতে তাঁর বাধেনি! তাই নিয়ে গোটা দেশ হুলুস্থুলু। পদক-টদক নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা। সে কী কাণ্ড! তখন গোটা দেশ উত্তাল হয়েছিল। তারপর আবার সময়ের নিয়মেই তা ঝিমিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু পুরনো সেই দিনের কথা ভোলা কি যায়! আপনি ভোলেননি। দেশবাসীও না। বিনেশের আস্পর্ধা আর একবার খেয়াল করুন! পরপর তিনজনকে মাটি ধরিয়ে একেবারে অলিম্পিক্সের ফাইনালে উঠে পড়লেন। আর দেশ, মনে রাখবেন রাষ্ট্র নয়, দেশ প্রায় একযোগে বলতে শুরু করল, এই মেয়ের প্রত্যেক লড়াইয়ে যেন পরাজিত হচ্ছেন ব্রিজভূষণ। কার্টুন, লেখা, বিনেশকে কুর্নিশ জানিয়ে অজস্র পোস্টে ছেয়ে গেল সমাজমাধ্যম। মনে হচ্ছিল, ভারতবর্ষ যেন ঘুমোচ্ছে না। পরের দিনের সকালের অপেক্ষা করছে। যাতে বিনেশ সোনা কিংবা রুপো জেতেন আর জবাবটা আরও মোক্ষম হয়। বলিহারি আস্পর্ধা! এমন দিনে কি চুপ করে থাকা মানায়! তাও যাঁর নাম কঙ্গনা রানাউত, তিনি কেন চুপ করে থাকবেন! অতএব আপনি সাতকাহন পাড়তে শুরু করলেন। এতকিছুর পরেও কীভাবে বিনেশকে দেশের সেরা সুবিধার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কত পরিষেবা তিনি পেয়েছেন দেশের থেকে। এমনকি দেশের প্রশাসনিক প্রধানের বিরুদ্ধে মুখ খোলার পরেও দেশ যে তাঁকে বিন্দুমাত্র অসুবিধায় পড়তে দেয়নি, তা মনে করিয়ে দেওয়া আপনার কর্তব্য বটে! আপনি গোটা দেশকে তা মনে করিয়ে দিতে চাইলেন।
কিন্তু কঙ্গনা, আপনি যেমন দেশের মেয়ে, বিনেশও তো তাই। আপনার দাবি-দাওয়া নিয়ে মুখ খোলার অধিকার থাকলে বিনেশেরও আছে। নেপোটিজমের বিরুদ্ধে আপনি খড়্গহস্ত হতে পারেন, আর যৌন নির্যাতনের মতো মারাত্মক অভিযোগে বিনেশ রাস্তায় নামবেন না! তা ছাড়া ভারত তো গণতান্ত্রিক দেশ। সেখানে শাসক থাকবে, বিরোধীও। যে সংসদে আপনি জায়গা পেয়েছেন, সেখানেই তো তার জলজ্যান্ত উদাহরণ মেলে! তাহলে, কোন সংবিধানে লেখা আছে যে, শাসকের বিরুদ্ধতা করলে দেশের কোনও সুবিধা মিলবে না! আর যদি মেলে তাহলে শাসকদলের নেতারা তাকে করুণা কিংবা দয়া হিসাবে তুলে ধরে কৃতিত্ব নেবেন, এরকম লেখা কোনও অনুচ্ছেদে থাকলে উল্লেখ করে দিতে পারতেন। রাজধর্ম বলেও একটি জিনিস আছে, আপনি জানেন নিশ্চয়ই। আপনার দলেরই স্মরণীয় প্রবাদপ্রতিম নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী যা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে। আশা করি, তা পালনের ক্ষেত্রে দেশের মানুষই প্রধান বিবেচ্য। কে কোন দলের সমর্থক তা বড় কথা নয়।
তবু বিনেশের আস্পর্ধা ভাবুন! এমন সাফল্যের কাছে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন, যে, আপনাকেও দু’কথা বলতে বাধ্য করলেন। আর তা বলতে গিয়েই প্রমাণ করে দিলেন, শাসক দল আর প্রশাসনের ভিতর কোনও পার্থক্য আপনি রাখেননি। রাখতে চান না। তাই দেশের নারীশক্তির এমন গৌরবের দিনেও, আপনি শাসকের খোঁটা না দিয়ে পারলেন না। ভাগ্যের দুর্বিপাক বলতে হবে, যে, শেষ পর্যন্ত বিনেশ পদক পেলেন না। সামান্য একশো গ্রাম ওজন বড্ড ভারী হয়ে চেপে বসল দেশের মনে। কিন্তু যে মেয়ে ফিনিক্স, তাকে আটকানো যায় কী করে! পদক হারালেও, দেশবাসীর চোখে হিরো হয়ে গিয়েছেন বিনেশ। পদক আর দেশের কাছে শেষ কথা নয়। বরং বিনেশের লড়াইয়ের রূপকথা জেগে আছে সকলের মনে। বিশেষ করে উল্লেখ করা প্রয়োজন, খোদ প্রধানমন্ত্রীও আজ খোলা পোস্টে সে কথাই জানিয়েছেন।
অথচ কঙ্গনা, আপনি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, বিনেশকে কত কত সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তিনি শাসকদলের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও। তার পর ঘটনা যেদিকে গড়াল, বিনেশ যেভাবে দেশের হৃদয়ে থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পৌঁছে গেলেন, তাতে আপনার কথাগুলো যে নেহাতই ঠুনকো হয়ে রয়ে গেল! নিজের কথার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই কি কোনওদিন কুঁকড়ে যাবেন আপনি! আমাদের জানা নেই। তবে, এ কথা আবারও প্রমাণিত, যাঁর প্রতিভা আছে, যিনি লড়াই করতে জানেন, তাঁর করুণা-দয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে, নেতাদের কিন্তু সংসদে বসে জনতার কাছেই ভোট চাইতে যেতে হয়। আপনার মনে থাকবে তো কঙ্গনা?