আরেক আন্দোলনের দিনে বাংলাদেশকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, “বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।” আজকের উত্তাল বাংলাদেশে যখন হিংসার ভয়ে কাঁটা সংখ্যালঘুরা, সে কথা কি মনে রাখবে বাংলাদেশ?
আন্দোলনের বাংলাদেশে বিপন্ন বঙ্গবন্ধু। উন্মত্ত জনতার ঝড়ে ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছে সেই মানুষটির মূর্তি, পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে সেই মানুষটির স্মৃতি ধরে রাখা মিউজিয়াম, যিনি একদিন এই দেশকে স্বাধীনতার মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপরেও। মূর্তি নাহয় ভাঙল। কিন্তু যে বঙ্গবন্ধু এমনই এক আন্দোলনের দিনে সমস্ত লড়াইয়ের মধ্যেও হিন্দু-মুসলিমকে রক্ষার কর্তব্য মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই কর্তব্য কি আদৌ মনে রাখবে আজকের বাংলাদেশ? যেভাবে সরকার পতনের পর দেশের নানা প্রান্ত থেকে সংখ্যালঘুর উপর হিংসার খবর ছড়িয়ে পড়ছে, সেই ভয়ের পরিবেশে এ প্রশ্ন জারি না রেখে উপায় নেই।
কী বলেছিলেন সেদিন বঙ্গবন্ধু?
আরও শুনুন:
ভাষার লড়াই থেকে শাহবাগ, আন্দোলনের পথে এগিয়েছে যে বাংলাদেশ…
সেদিন ১৯৭১-এর ৭ মার্চ। ঢাকার রমনা। রেসকোর্স ময়দান। সেদিনই শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত কণ্ঠে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন অত্যাচারী শাসককে- “আমাদের আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।” বিশ্বজুড়ে গণ আন্দোলনের ইতিহাস সেই ঘোষণাকে মনে করে রেখেছে। এমনকি সাম্প্রতিক কালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের ঝাঁপিয়ে পড়া দেখেও ‘জাতির পিতা’র সে কথাটিই মনে পড়ে গিয়েছে অনেকের। কিন্তু সেদিন বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র মুক্তির সংগ্রামের ডাকই দেননি। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন শাসকের অত্যাচারে বাংলার মানুষের রক্ত ঝরার কথা। বলেছিলেন, “আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে, আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমার দুখি জনতার উপর চলছে গুলি।” যদিও, কেবল জনতাকে হত্যা করে আন্দোলন থামানো যায় না, তাই শাসক আন্দোলনের জনতার মধ্যে ঢুকে পড়ে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিতেও চায়। বিচ্ছিন্নতা বাসা বেঁধে থাকে আমজনতার মধ্যেও। আর সেই গোপন শত্রুকে নিয়েই সেদিন সাবধান করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভবিষ্যৎ আন্দোলনের সমগ্র রূপরেখা সাজিয়ে দেওয়ার পরই তিনি বলেছিলেন, “হুঁশিয়ার, একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্মকলহের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।”
আরও শুনুন:
ভাষাকে ভালবেসেই শহিদ-তর্পণ, একুশে স্মরণ তাঁদের ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন যাঁরা
বঙ্গবন্ধু সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে উলটোদিকে দাঁড়িয়ে ভেদাভেদ করা চলে না। তাতে আদতে শক্তিক্ষয়ই ঘটে। দুর্বল হয় আন্দোলন। আর শাসকের বিরুদ্ধে যদি হিংসার অভিযোগে আঙুল তোলা হয়, তবে বিরোধীরা নৈতিকভাবেই হিংসার ঢেউয়ে গা ভাসাতে পারেন না। তেমনটা হলে তাঁদের মুখেও একসময় চেপে বসবে আগের শাসকের মুখোশই। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করতে চাওয়া আজকের বাংলাদেশে সে ভাবনা প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরেও সে দেশে হিংসার ঘটনা ঘটছে, অভিযোগ উঠছে হিন্দুদের প্রতি আক্রমণেরও। তবে এ কথাও সত্যি, দেশে যে বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়েছে, সেখানে হিন্দু এবং সংখ্যালঘু ভাইবোনদের হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। সেই পুরনো কথার সুরেই যেন তাঁরাও বলছেন, ‘আমাদের আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা এবং পরিকল্পনা চলছে।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, সোশাল মিডিয়ায় নিজেদের ফোন নম্বর ছড়িয়ে দিচ্ছেন হেল্পলাইন হিসেবে। একদিকে যেমন সংখ্যালঘুদের আক্রমণের অভিযোগ উঠছে, অন্যদিকে রামকৃষ্ণ মিশন কিংবা কালী মন্দির পাহারা দিচ্ছেন মুসলিম যুবকেরাই- এমন ছবিও ছড়িয়ে পড়ছে নেটদুনিয়ায়। বঙ্গবন্ধুর মূর্তি নাহয় ভাঙা হল, তবে বঙ্গবন্ধুর হিন্দু-মুসলিমকে রক্ষার সে কর্তব্য নতুন বাংলাদেশের মনে থাকবে তো? ইতিহাসের কাছে তোলা রইল সে প্রশ্ন।