যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল ১৭ বছরের মেয়েকে। সাঁতার কেটে পৌঁছেছিলেন অন্য দেশে। সেখান থেকে অলিম্পিক্সের মঞ্চে উঠে দাঁড়ান হার না মানা তরুণী। আসুন, শুনে নিই তাঁর কথা।
ফাইট, কোনি, ফাইট। মতি নন্দীর ‘কোনি’ উপন্যাসের সেই সাঁতারু মেয়ের কথা মিথ হয়ে গিয়েছে কবে। জলের বাধা কাটিয়ে এগোতে এগোতে সে মেয়ে যেন দূরে ঠেলে দিত জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতাকেই। সেই কোনির মতোই বাস্তবে সব বাধাকে সাঁতরে পেরিয়ে যেতে চান উসরা মর্দিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই নিজের দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল তাঁকে। যুদ্ধের দিনে প্রাণ বাঁচাতে আর কোনও উপায় ছিল না। তখনও সাঁতার কেটেই অন্য দেশে পৌঁছেছিলেন তিনি। আর পরবর্তী কালে, সাঁতারের জোরেই তিনি পৌঁছে যান অলিম্পিক্সের মঞ্চে। সাঁতারু হওয়ার স্বপ্ন দেখা মেয়ের এই সফর যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করা রূপকথারই গল্প।
:আরও শুনুন:
কথা দিয়েছিলেন ছাত্রী, মনুর জয়ে প্রতিশ্রুতি পূরণের স্বাদ পেলেন প্রাক্তন শিক্ষিকা
সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে জন্ম হয়েছিল মর্দিনি। সাঁতার শিখতে শিখতেই ছোট্ট বুকে বাসা বেঁধেছিল অলিম্পিক্সে পদক জয়ের স্বপ্ন। ছোট্ট মেয়ে স্বপ্ন দেখত, একদিন দেশের পতাকা বয়ে নিয়ে বিশ্বের সেরা ক্রীড়ামঞ্চে উঠে দাঁড়াবে সে। কিন্তু, সব গল্প তো সত্যি হয় না। মর্দিনির গল্প দানা বাঁধার আগেই গৃহযুদ্ধ বেধে গেল তার দেশে। তখনও কৈশোর পেরোয়নি মর্দিনির। অথচ তার জীবনে ফুল, ভালোবাসা, রঙের গন্ধ ঢেকে দিয়েছে বারুদ, রক্ত আর মৃত্যুর গন্ধ।
কিন্তু এভাবে বেশিদিন চালানো গেল না। ২০১৫ সালে প্রাণে বাঁচার জন্য দেশ ছাড়ার কথা ভাবল মর্দিনির পরিবার। মর্দিনি ও তাঁর বড় বোনকে পাঠিয়ে দেওয়া হল সেই গোপন যাত্রায়। লেবানন হয়ে তুরস্কে পৌঁছান দুই বোন। সেখান থেকে চোরাপথে এজিয়ান সমুদ্র পেরিয়ে গ্রিসে ঢোকার মতলব ছিল, কিন্তু মাঝপথেই বিকল হয়ে গেল নৌকার ইঞ্জিন। জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দুই বোন। নৌকা ঠেলে ঠেলে নিয়ে চললেন। কয়েক ঘণ্টার সাঁতারের পর দেখা গেল গ্রিসের উপকূল। তবে বিপদ তো তখনও কাটেনি। শেষমেশ জার্মানিতে পৌঁছে এল খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার সুযোগ। শুরু হল সাঁতারও। ২০১৬ সালে শরণার্থী অলিম্পিক দলের সদস্য হিসেবে রিও অলিম্পিক্সে নির্বাচিত হন মর্দিনি। ২০২০-তেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
:আরও শুনুন:
গর্ভে ৭ মাসের সন্তান, তবু অলিম্পিকে লড়ে কুর্নিশ আদায় হবু মায়ের
না, নিজের দেশের পতাকা বইতে পারেননি মর্দিনি। নিজের দেশের হয়ে পদক জেতাও হয়নি। কিন্তু তাঁর এই গোটা সফরটাই তাঁর মাথায় পরিয়ে দিয়েছে অলিভ পাতার মুকুট। গোটা দুনিয়ার সামনে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার মুখ তুলে ধরেছেন উসরা মর্দিনি। তাঁর জীবন নিয়ে যখন সিনেমা হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় সে খবর জানিয়ে মর্দিনি সোচ্চারে জানিয়ে দেন- আয়্যাম বুলেটপ্রুফ! জানান, তাঁর কিচ্ছু হারানোর নেই। সুতরাং তিনি কথা বলতে পারেন, চেঁচিয়ে উঠতে পারেন।
সব মানুষ চোখে দেখার মতো সাফল্য পান না। কিন্তু কারও কারও জীবনে বেঁচে থাকাটাই সাফল্য হয়ে ওঠে। সে বেঁচে থাকাকে কুর্নিশ জানায় বিশ্ব। এক হার না মানা মেয়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে অলিম্পিক্সের মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার এই সফর আসলে ঠিক তেমনই একটা রূপকথা।