আষাঢ় একাদশীতে যোগনিদ্রায় মগ্ন হন নারায়ণ। চারমাস পর নিদ্রাভঙ্গ হয় তাঁর। অথচ শাস্ত্র বলছে মাত্র চার প্রহরের জন্যই বিশ্রাম নেন শ্রীবিষ্ণু। তাহলে মর্ত্যে কেন এতদিন সময় লাগে নারায়ণের নিদ্রাভঙ্গে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
মধু-কৈটভের অত্যাচারে ত্রিলোকে ত্রাহি ত্রাহি রব। এদিকে সৃষ্টির পালনকর্তা নারায়ণ যোগনিদ্রায় মগ্ন। নিরুপায় ব্রহ্মা মহামায়ার ধ্যানে বসলেন। দেবীর কৃপায় শ্রীবিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গ হল। নারায়ণ বধ করলেন দুর্ধর্ষ দুই অসুরকে। পুরাণের এই কাহিনি কমবেশি সকলেরই জানা। কিন্তু শ্রীবিষ্ণু কেন যোগনিদ্রায় মগ্ন হয়েছিলেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে।
:আরও শুনুন:
বিষ্ণুর রূপের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব, কী মাহাত্ম্য মোহিনী একাদশীর?
পুরাণে বিষ্ণুর যোগনিদ্রা নিয়ে কয়েকটি ব্যাখ্যা মেলে। সবথেকে প্রচলিত কাহিনিতে বিষ্ণুর বামন অবতারের উল্লেখ রয়েছে। পুরাণমতে নারায়ণের পঞ্চম অবতার বামনরূপে অসুররাজ বলিকে পরাজিত করেছিলেন। যদিও অন্যান্য অসুরদের মতো তেমন ভয়ঙ্কর ছিলেন না বলি। বরং অতিরিক্ত দান করার জন্যই বিখ্যাত ছিল তাঁর নাম। সেই দানের বশেই নারায়ণের মায়ায় আবদ্ধ হন বলি। পুরাণের কাহিনি অনুযায়ী, মহারাজ বলি তখন স্বর্গলোক আক্রমণের প্রস্তুতি সারছেন। পাতাল লোক এমনিতেই তাঁর রাজত্ব। মর্তেও তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস নেই কারও। স্বর্গজয় করলেই ত্রিলোকের অধিপতি হবেন তিনি। বিপদ বুঝে আগেভাগে নারায়ণের স্মরণ নিলেন দেবতারা। আর আগে বিভিন্ন অবতারে অসুরদের বধ করেছেন বিষ্ণু। কিন্তু বলিকে বধ করার জন্য নারায়ণ অন্য ছল করেন। বামন ব্রাহ্মণ সেজে বলিরাজের সামনে হাজির হন নারায়ণ। যজ্ঞ সেরে সবেমাত্র দানধ্যান আরম্ভ করেছেন বলি। বামন ব্রহ্মচারীকে দেখেই কড়জোরে এগিয়ে গেলেন। ইনিই যে নারায়ণ, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। উলটে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেললেন, বামন যা চাইবেন বলি তাই দেবেন। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন শ্রীবিষ্ণু। বলির প্রতিশ্রুতি পেয়েই নিজমূর্তি ধরলেন নারায়ণ। এক পায়ে পৃথিবী, দ্বিতীয় পায়ে আকাশ মেপে নিলেন। তৃতীয় পা বলির মাথায় রাখতেই পাতাল লোকে প্রবেশ করলেন নারায়ণ। অসুররাজের ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকেই পাতালের অধিপতি করে দিলেন বিষ্ণু। সেইসঙ্গে বলিকে একটি বর চাইতে বললেন। বর হিসেবে বলিরাজ শ্রীবিষ্ণুকে চিরকালের জন্য পাতালে অধিষ্ঠান করার অনুরোধ জানালেন। প্রতিশ্রুতি মতো বিষ্ণু এমনটা করতে বাধ্য ছিলেন। এইসময় দেবী লক্ষ্মী বিশেষ উপায়ে নারায়ণকে স্বর্গে নিয়ে যান। কিন্তু বলিকে দেওয়া কথা নারায়ণ ভুলে যাননি। বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে চার প্রহরের জন্য পাতালে বিশ্রাম নিতে যাবেন, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বৈকুন্ঠ্যে ফিরলেন নারায়ণ। তাই প্রতি বছর আষাঢ় একাদশীতে পাতালে বিশ্রাম নিতে যান নারায়ণ। তবে পাতালের হিসাবে চারপ্রহর পার করতেই মর্তলোকে চার মাস সময় লেগে যায়। এই সময়টুকুই বিষ্ণুর যোগনিদ্রা হিসেবে ধরা হয়। যদিও মধু কৈটভ বধের সময় নারায়ণ যে নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন, সেই যোগনিদ্রার সঙ্গে পাতালের যোগ নেই। শাস্ত্রমতে, এই যোগনিদ্রা নারায়ণের এক লীলামাত্র।
:আরও শুনুন:
দশমহাবিদ্যার অন্যতমা দেবী ষোড়শী, সেই রূপেই মা সারদার পূজা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
পুরাণে অবশ্য বিষ্ণুর বিশ্রাম নিয়ে আরও কিছু কাহিনি প্রচলিত। কথিত আছে, শঙ্খচূড় নামে এক অসুরের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধে মত্ত হয়েছিলন নারায়ণ। শেষমেশ ছল করে ওই দৈত্যকে পরাস্ত করেন বিষ্ণু। তবে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। দেবতাদের অনুরোধেই বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নেন নারায়ণ। অষ্টনাগের অনন্ত শয্যায় তাঁর সেই যোগনিদ্রা চলে। এখানেও সময়ের হিসাব পাতালের মতোই। অর্থাৎ মাত্র চার প্রহরের জন্য বিশ্রাম নেন বিষ্ণু। অথচ মর্তে সেই সময় কাটতে চার মাস লেগে যায়। যোগনিদ্রা সম্পর্কে এমনই আরও অনেক কাহিনি রয়েছে। তার মধ্যে কোন ব্যাখ্যা একমাত্র সঠিক তা নিয়ে দ্বিধায় থাকেন শাস্ত্রজ্ঞরাও।