নিজের হাতে আশা ভোঁসলের পা ধুয়ে দিচ্ছেন সোনু নিগম। সেই দৃশ্য সামনে আসতেই শোরগোল। ভারতবর্ষে গুরুকে পুজো করার চল অবশ্য নতুন নয় আদৌ। শুনে নেওয়া যাক।
মঞ্চে আশা ভোঁসলের পায়ের কাছে বসে সোনু নিগম। বর্ষীয়ান গায়িকার পায়ে চুম্বন করে তাঁর দু’পা গোলাপ জল দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছেন নিজের হাতে। গুরু হিসেবেই সম্মান জানাচ্ছেন তাঁকে। আর এ দৃশ্যই ভারতবর্ষের গুরুবাদী সংস্কৃতিকে নতুন করে উসকে দিল। যে সংস্কৃতি গুরুকে কার্যত পুজো করার কথাই বলে। পুজো, অর্থাৎ প্রশ্নহীন আনুগত্য। আর প্রাচীন কাল থেকেই সেই ভাবনা চলে আসছে এ দেশে। মহাকাব্য থেকে চর্যাপদ, সবেতেই তার ছাপ। কথায় বলে, যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে। সেই ভারত, অর্থাৎ মহাভারতের কথা যদি ধরা হয়, সেখানেও দেখা যাবে মহাভারতকার কথায় কথায় গুরুর প্রতি এহেন আনুগত্যের পাঠই দিয়েছেন।
আরও শুনুন:
সোডার বোতল থেকে বালতি! রাহুল দেব বর্মণের সুরে সংগত করত ‘বেসুরো’ জিনিসও
গুরু দ্রোণের কথা তো সবারই জানা। কখনও তাঁর আদেশে বিনাবাক্যে নিজের আঙুল কেটে গুরুকে নিবেদন করেছেন একলব্য। ব্যাধ যুবকের আঙুল কেটে নেওয়ার ঘটনা যতই অমানবিক হোক, সে কাহিনি আজও গুরুভক্তির চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে আসছে। কখনও আবার গুরুদক্ষিণা দিতেই দ্রুপদের রাজ্য আক্রমণ করেছেন কুরুপাণ্ডবেরা, হস্তিনাপুরের সঙ্গে পাঞ্চালের কোনও রাজনৈতিক শত্রুতা ছাড়াই। আবার মহাভারতেই গুরু আয়োদধৌম্যর কথা মেনে দিনের পর দিন অনাহারে থেকেছেন শিষ্য উপমন্যু। শেষ পর্যন্ত আকন্দ পাতা খেয়ে তিনি অন্ধ হয়ে যান। যদিও তার পরেও গুরুর প্রতি কোনও রাগ-ক্রোধ ছিল না আঁর। গুরুদক্ষিণা দিতে গিয়ে পাতালে পর্যন্ত পৌঁছে যান ঋষি বেদ-এর শিষ্য উতঙ্ক। তেমনই বিশ্বামিত্রের শিষ্য গালব নিজের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্য প্রাণপাত করেন। এমনকি তার জন্য রাজা যযাতির কন্যা মাধবীকে একের পর এক রাজার শয্যায় পাঠাতেও তাঁর আপত্তি ছিল না। মানবিক বিচারেও এ কাজকে আদৌ সংগত বলে মনে হবে না, কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, ব্যক্তিগত স্বার্থপূরণের জন্য তিনি এ কাজ করেননি। গুরুর প্রতি আনুগত্য তাঁদের এতটাই প্রবল ছিল যে, গুরুর কথা রাখতেই জীবন দিতেও পারতেন তাঁরা।
আরও শুনুন:
যৌনকর্মী, কিন্তু ‘ভালো মেয়ে’! দর্শকের খিদে মেটাতে যে পথে হেঁটেছে বলিউড
ভারতবর্ষের প্রাচীন কাব্য-পুরাণ-দর্শনে ছড়িয়ে আছে গুরুর প্রতি আনুগত্যের এই ভাবনাই। সংস্কৃতে ‘গূ’ শব্দের অর্থ, অন্ধকার, ‘রু’ শব্দের অর্থ আলো। গুরু শব্দের সমগ্র অর্থ, যিনি অন্ধকার থেকে আমাদের আলোর দিকে নিয়ে যান। সেই ধারণায় ভিত্তি করেই গুরুপূর্ণিমার প্রচলনও রয়েছে এ দেশে। সেখানেও গুরুকে কার্যত পূজা করাই হয়। আসলে, যিনি সম্মাননীয়, তাঁকে সম্মান দেওয়াই তো যথার্থ কর্তব্য। সেই নিরিখে গুরুকে সম্মান করারই কথা। কিন্তু সেই সম্মান যদি পূজায় পরিণত হয়, তবে তাতে একরকমের সমস্যাও রয়ে যায়। পূজা যেহেতু প্রশ্নহীন আনুগত্যেরই রূপ, ফলে সে সম্পর্কে একজন উঁচুতে আর একজন নিচুতেই অবস্থান করেন। আর এই আধিপত্যের অবস্থান একজনকে সর্বশক্তিমান বলে মনে করায়, অন্যজনকে প্রশ্ন করার অধিকার দেয় না। প্রশ্ন করতে ভুলে গেলে, অপরের কথা-কাজ যাচাই করতে না জানলে আহত হয় মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য না থাকা, একই ছাঁচে গড়া শিষ্য পেয়ে কোনও যথার্থ গুরুরও তৃপ্ত হওয়ার কথা নয়। কারণ যিনি অন্ধকার থেকে আলোতে যাওয়ার পথ দেখান, তিনি তো সেই আলোয় সবকিছুকে স্পষ্ট করে দেখতেই শেখান। আর সেখান থেকেই প্রশ্ন তৈরি হয় শিষ্যের মনে। পূজার অভ্যাসে সেই পারস্পরিক আদানপ্রদানের চর্চা ব্যাহত হলে তাতে শিষ্যের ক্ষতি, ক্ষতি গুরুরও।