উৎসবের সঙ্গে খাবারের যোগ আগাগোড়া। সেই নিয়মেই রমজানি ইদের চোখের মণি যে খাবার, তার নাম বাকরখানি। যদিও নিছক খাবার নয়, একে তাজমহলের মতোই প্রেমের স্মারক বললেও ভুল হয় না। শুনে নিন সে গল্প।
ঘরোয়া আয়োজন থেকে উৎসবের আনন্দ, যে কোনও ছুতোয় খাবার ছাড়া বাঙালির মন ভরে না। আর এইভাবেই কোনও উৎসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জুড়ে যায় কোনও কোনও খাবার। যেমন রমজান আর ইদের সঙ্গে মিলেমিশে আছে বাকরখানি। প্রতুল মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি/ বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি! এই বিশেষ খাবারটি বাংলায় কতখানি প্রিয়, তা তো এখান থেকেই স্পষ্ট। তবে বাকরখানির জন্ম বাংলাদেশে। সেখানে যে খাবার বহুপ্রচলিত, এপার বাংলায় তা সবসময় সহজে মেলে না। তবুও রমজান জুড়ে বাকরখানি ছাড়া যেন সম্পূর্ণ হয় না ইফতার। পুরুষ্টু, গোলাকার রুটি যেন অনেকটা বান রুটির মতো। আবার অনেকেই বলেন, ঢাকার আসল বাকরখানি একেবারেই বিস্কুট বা প্যাটিসের মতো মুচমুচে। যা চাইলে কয়েক মাস ধরে রেখে একটু একটু করে খাওয়া সম্ভব। নোনতা বা মিষ্টি, নানা রূপে তার অবতার। কোরবানি ইদের সময় প্রচুর মাংস পাওয়া যায়। এই মাংস জ্বাল দিতে দিতে ঝুরো ঝুরো হয়ে গেলে তার পুর দিয়েই তৈরি হয় ঝাল বাকরখানি। আবার বুদ্ধদেব বসুর ‘গোলাপ কেন কালো’ উপন্যাসে পান্তুয়া বা চিনিতে রসানো বাদাম সহযোগে বাকরখানি খাওয়ার বর্ণনা মেলে। মিষ্টি থেকে ঝাল, নানারকম অবতারের দরুন চা থেকে মাংসের ঝোল সবেতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় বাকরখানি।
কিন্তু এ খাবারের জনপ্রিয়তা তার স্বাদের জন্য যতখানি, তেমনই এর সঙ্গে জুড়ে থাকা গল্পের জোরও কম নয়। সে গল্প প্রেমের। দুই নরনারীর একে অপরকে চাওয়া আর না-পাওয়ার গল্প।
আরও শুনুন:
মিঠে শীতে পিঠের পাঁচালি… শুধু রসনাবিলাস নয়, স্বাদের আড়ালে খোঁজ সংস্কৃতিরও
শোনা যায়, সে সময়ে বাংলার মসনদে আসীন মুর্শিদকুলি খাঁ। তুরস্কের অধিবাসী তরুণ আগা বাকের ভাগ্যের অন্বেষণে আসেন ভারতবর্ষে। নাম লেখান সেনাবাহিনীতে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে মুর্শিদকুলি খাঁর সেনাবাহিনীতে উঁচু পদও পান। এর মধ্যেই খনি বেগমের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া হয় তাঁর। কেউ বলেন তিনি ছিলেন বাইজি, কেউ আবার বলেন কোনও আমিরের কন্যা। কিন্তু উজিরে আলা জাহান্দর খাঁর পুত্র জয়নুল খাঁরও দৃষ্টি পড়েছিল খনি বেগমের ওপর। রটে যায়, আগা বাকের জয়নুলকে হত্যা করে লাশ গুম করেছেন। শাস্তি হিসেবে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বাকেরকে। কিন্তু জ্যান্ত বাঘের সঙ্গে লড়ে বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে আসেন আগা বাকের। তবে এই সুযোগেই লুকিয়ে থাকা জয়নুল খাঁ খনি বেগমকে অপহরণ করে পালিয়ে যান ভাটি বাংলার গহিন অরণ্যে। কিন্তু খনিও যে ভালোবেসেছিলেন আগা বাকেরকেই। তাঁকে বশ করতে না পেরে চন্দ্রদ্বীপে আটকে রাখেন জয়নুল। সে খবর পেয়ে খনি বেগমকে মুক্ত করতে ছুটে যান বাকের। লড়াইয়ে মৃত্যু হয় জয়নুলের। কিন্তু তার আগেই মোক্ষম আঘাত করে যান জয়নুলও, নিজে মরার আগে ছুরি বসিয়ে দেন খনি বেগমের বুকে। শোকে পাগল বাকের খানও নাকি আর মুর্শিদাবাদে ফেরেননি। তাঁদের এই প্রেমের সুর ধরেই এই নতুন ধরনের রুটির নাম হয়েছিল বাকের-খনি, এমনটাই বলে জনশ্রুতি।
তবে, এ গল্প আসলে জনশ্রুতিই। ইতিহাসের তথ্যপ্রমাণে এর কোনও জায়গা আছে কি না, তা নিশ্চয় করে বলা ভার। তবে ইতিহাস থাক বা না থাক, খাবারটি কিন্তু আছে। আর তার স্বাদ কিংবা জনপ্রিয়তা, দুই-ই হাজির বহাল তবিয়তে।