ভোটের অঙ্ক বদলাতে গুরুত্বপূর্ণ মহিলা ও সংখ্যালঘু ভোটারেরা। সে কথা মাথায় রেখেই সুযোগ-সুবিধার কথাও আসে বইকি। তবু ভোটের ফলে এবার কমল মহিলা ও সংখ্যালঘু সাংসদের সংখ্যা।
মহিলা ও সংখ্যালঘু ভোটার, দুই-ই যে বর্তমানে ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ, তা অস্বীকার করার জো নেই। ফলে ভোটের খেলা ঘোরাতে এই দুই গোষ্ঠীকেই দলে টানতে চায় কমবেশি সব রাজনৈতিক দলই। সে কথা মাথায় রেখেই শাসক দলের তরফে নানারকম সুযোগসুবিধার কথা ঘোষণা করা হয়। উলটোদিকে বিরোধী শিবির থেকেও প্রতিশ্রুতি ভেসে আসে, ভোটে জিতলেই উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাবে এতদিনকার না-পাওয়া। অর্থাৎ না-পাওয়া যে রয়েছেই, তা স্বীকার করে নেওয়া হয় দু’তরফেই। কিন্তু অন্য কেউ বাইরে থেকে সে অপ্রাপ্তির ভর্তুকি দেবেন, এমনটা তো উন্নতির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। অপ্রাপ্তির ভিতর থেকেই কেউ উঠে দাঁড়িয়ে সেই না-পাওয়ার কথা বলবেন, বঞ্চনার হিসেব দেবেন, সরব হবেন অধিকার আদায়ের দাবিতে- এমনটা না হলে কি বদল আসে! কিন্তু লোকসভা ভোটের পর তেমন প্রতিনিধির পরিসংখ্যানটা ঠিক কী দাঁড়াল? সংসদে নিজেদের কথা পৌঁছে দেওয়ার মতো কতজনকে পেলেন এই দুই শ্রেণির মানুষেরাই?
আরও শুনুন:
রামের অযোধ্যায় জিতলেন একজন দলিত নেতা, কে এই অওধেশ প্রসাদ?
ভোটের হিসেব বলছে, সংখ্যাটা কমেছে। দু’পক্ষেই। উনিশের ভোটের তুলনায় কমে গিয়েছে চব্বিশে নির্বাচিত মহিলা ও সংখ্যালঘু সাংসদের সংখ্যা। গতবারে সংসদের নিম্নকক্ষে ৭৮টি আসন বরাদ্দ হয়েছিল মহিলাদের জন্য, এবারে যে সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৪-এ। মনে রাখা ভালো, এর মধ্যে কিন্তু মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হয়ে গিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছিল, লোকসভা ও বিধানসভায় এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে মহিলাদের জন্য। কিন্তু প্রার্থী বাছাইয়ের সময় কোনও দলই যে তেমন অনুপাত মনে রাখেনি, প্রার্থীতালিকা থেকে সে কথা স্পষ্ট হয়েছিল আগেই। পুরুষ প্রার্থীর তুলনায় মেয়েরা ভোটে দাঁড়িয়েই ছিলেন কম সংখ্যায়, সব মিলিয়ে ৭৯৭ জন। তার উপরেও কংগ্রেসের গেনিবেন ঠাকর-এর মতো কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন, দলের থেকে তেমন সহায়তাও পাননি প্রচারের সময়। তবুও তাঁরা জিতেছেন বইকি। সাংসদ পদ খারিজ হয়ে যাওয়ার পরেও এবার ফের চোখা প্রশ্ন তুলতে সংসদে ফিরেছেন মহুয়া মৈত্র। সম্ভবী, সঞ্জনা, প্রিয়া-রা নাম তুলে ফেলেছেন সর্বকনিষ্ঠ সাংসদের তালিকায়। কিন্তু তাতেও মূল প্রশ্নটা মুছছে না। সংসদে মহিলা প্রতিনিধির সংখ্যা যে এখনও চোখে পড়ার মতোই কম, তা তো দেখাই যাচ্ছে। সে কথাটাই বলা চলে সংখ্যালঘু সাংসদদের ক্ষেত্রেও। ইউসুফ পাঠান, আসাদউদ্দিন ওয়াইসি-রা জিতেছেন ঠিকই। কিন্তু মোট সাংসদের মধ্যে মুসলিম সাংসদের সংখ্যা ২৪। উনিশের লোকসভার থেকেও দুজন কম। গতবারে বিভিন্ন দল থেকে ১১৫জন মুসলিম সদস্য প্রার্থী হলেও, এবারে প্রার্থীর সংখ্যাই ছিল মাত্র ৭৮।
আরও শুনুন:
আসন না হোক, বিভাজন-মন্তব্যে ৪০০ পার মোদির! হিসেব তুলে দাবি খাড়গের
হ্যাঁ, এ কথা বলাই যায় যে, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে লিঙ্গপরিচয় বা জাতিগত পরিচয়ের বদলে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কিন্তু কার রাজনৈতিক দক্ষতা কতখানি, কেবল জাতি বা লিঙ্গপরিচয়ের দরুন তা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কি না, সে কথাও তো খতিয়ে দেখতে হবে। ভোটপ্রচারে কোনও নেতা অনায়াসে বলে বসেন, রাজনীতির ময়দানে নয়, মেয়েরা কেবল রান্নাঘরে থাকতেই পারেন। আবার বিরোধী দলের মেয়েদের দাম বেঁধেও দেন অন্য দলের কেউ। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী-সহ একাধিক নেতানেত্রীর মুখে লাগাতার শোনা যায় বিভাজন মন্তব্য, যা সংখ্যালঘুকে বাকি দেশের কাছে আতঙ্কের করে তোলে ক্রমশ। এই পরিস্থিতিতে মহিলা কিংবা মুসলিম প্রার্থীরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ কতখানি পাবেন, সে কথাও তো ভেবে দেখার। অথচ ভোটব্যাঙ্কের হিসেবে কিন্তু তাঁদের গুরুত্ব কমে না। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ থেকে ‘লাডলি বহেন যোজনা’, ফ্রি বাস পরিষেবা, মহিলাদের কথা ভেবে এমন নানা প্রকল্প এনেছে দলগুলি। এমনকি, জাতপাত নিয়ে মন্তব্য করলেও, তিন তালাক রদ বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সুবিধা বুঝিয়ে মুসলিম মহিলাদের কাছে টানতে চেয়েছে বিজেপি শিবিরও। ইমাম ভাতা বা সংরক্ষণের আশ্বাসের মতো নানা ইস্যুতে একাধিক দল সংখ্যালঘুদের দিকে ঝুঁকে থাকার অভিযোগ কুড়িয়েছে। কিন্তু ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে আম ভোটারকে গুরুত্ব দিলেও, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সেই গুরুত্ব কিন্তু ছাপ ফেলল না। প্রার্থীসংখ্যার ক্ষেত্রে যে ঘাটতি রয়ে গিয়েছিল, সেই ঘাটতি স্বাভাবিকভাবেই জারি রইল নির্বাচিত সাংসদের সংখ্যাতেও। ভোটব্যাঙ্কের বড় অংশ জুড়ে থাকলেও, সংসদে কমেই গেল মহিলা ও সংখ্যালঘু সাংসদের সংখ্যা।