জনপ্রিয়তার জন্য রিল বানানোই একমাত্র পথ নয় আর। বই পড়েও সোশাল মিডিয়ায় দিব্যি জনপ্রিয় হতে পারেন কিন্তু। সে পথ দেখাচ্ছে ‘বুকস্টাগ্রাম’। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
স্ক্রিনটাইমেই বারোটা বাজছে চোখের। বইয়ের পাতায় চোখ পড়েই না আর। তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে এই অভিযোগ তো অনেকদিনের। এবার এই অভিযোগের পালটা দিচ্ছে তারা, সেই স্ক্রিনের হাত ধরেই। হ্যাঁ, সোশাল মিডিয়ায় নয়া সংযোজন বুকস্টাগ্রাম। আর সেই ভারচুয়াল জগতেই আনাগোনা বাড়ছে নতুন প্রজন্মের বইপ্রেমীদের। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের চক্করে এ প্রজন্মে বৌদ্ধিক চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে, তারা হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক, এমন নানা কথাই তো ওঠে। কিন্তু সোশাল মিডিয়ার সঙ্গেই এখানে মিলে গিয়েছে বৌদ্ধিক চর্চার সূত্রটি। একইসঙ্গে, সেই পথেই বেঁধে বেঁধে থাকার সুতো খুঁজে নিচ্ছেন এ প্রজন্মের অনেকেই।
কোভিডকালেই আসলে বুকস্টাগ্রামের পথচলা শুরু। সেসময়ে ঘরবন্দি মানুষকে ভারচুয়াল দুনিয়া ভয় দেখাচ্ছিল আরও বেশি করে। আবার এ কথাও সত্যি যে তখন অনেকটা ফেলাছড়া সময় হাতে এসেছিল অনেকেরই। সেই সময়ে অনেকেই বই পড়ার অভ্যাসে ফেরেন, বা অভ্যাসটা শুরু করেন। এবার কী খেলেন, কী কিনলেন, কোথায় ঘুরতে গেলেন, জীবনের যাবতীয় কাজের খতিয়ান সোশাল মিডিয়ায় দেওয়ার অভ্যাস তো কবে থেকেই হয়ে আছে। সেখানে জুড়ে যায় বইয়ের খবর দেওয়ার অভ্যাসও। দেখা যায়, ইনস্টাগ্রামে বহু মানুষই বইয়ের ছবি, পাঠপ্রতিক্রিয়া, সাজেশন দিয়ে চলেছেন লাগাতার। তাঁদের দেখাদেখি সে দলে নাম লেখাতে থাকেন আরও মানুষ। হঠাৎ করেই, অন্য সব জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগকে পিছনে ফেলে সামনের সারিতে উঠে আসে ‘রিডিং’। ইনস্টাগ্রামের বইপ্রেমী কমিউনিটির নামই হয়ে যায় বুকস্টাগ্রাম। একইভাবে টিকটকে হাজির হয় বুকটক।
হ্যাঁ, সব ভালোর মধ্যে উলটো কথাও কি ছিল না? সোশাল মিডিয়ার জগৎটা যে অসহিষ্ণুতাকে চিনিয়ে দেয়, যেখানে ভিন্ন মতের জায়গা নেই, সে অভ্যাস এখানেও চালু ছিল। প্রায়শই দেখা গিয়েছে, কোনও জনপ্রিয় বই সম্পর্কে কেউ অন্যরকম কথা বললে ভক্তকুল রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই এ অভিযোগ তুলেছেন যে, সোশাল মিডিয়ার সুর মেনেই এই বইপড়ায় অন্যকে দেখানোর ভাবটা বড় বেশি প্রবল। বইয়ের বিশ্লেষণী পাঠ বা তার অভ্যাসটাই এখানে সেভাবে নেই। আর ইনস্টাগ্রাম যেহেতু মূলত ছবিনির্ভর, ফলে পুরনো বই রিভিউ সাইটগুলির তুলনায় এখানে ভালো ছবির গুরুত্বও অনেক বেশি। বইয়ের প্রচ্ছদের সুন্দর ছবি দেওয়াটাও এখানে একরকমের প্রতিযোগিতা। পাশাপাশি বই পড়া এখানে যতখানি মনের খোরাক, তার চেয়ে বেশি যেন পারফরম্যান্স।
কথা হল, কেবল রসগ্রাহী পড়ার বদলে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণের ইচ্ছে বা ক্ষমতা সকলের থাকে না। তা কিছুসংখ্যক মানুষই করেন, করবেনও। কিন্তু হালকা চালে বই পড়ার একটা চলও বরাবরই ছিল। বই পড়া যে বৌদ্ধিক বা সাংস্কৃতিক চর্চাকে জিইয়ে রাখে, সে চর্চা ছাড়াও, বই পড়াই ছিল একসময়ের বড় বিনোদন। বিনোদনের অন্য চটজলদি, চোখধাঁধানো পথগুলো তখনও মানুষের হাতের নাগালে আসেনি। কিন্তু প্রথমে টিভি আর তারপরে কম্পিউটারের দৌলতে, সেই বিনোদনের ধরনটাই আমূল বদলে গেল। তবে সময়কে তো আর পিছনে হাঁটানো যায় না। বদলে আধুনিকতার সঙ্গে যদি সেই পুরনো সময়কে একভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায়, মন্দ কী! যারা সোশাল মিডিয়াতেই প্রভূত সময় কাটান, সেখানেই বই পড়ার পরিসর তৈরি হলে হয়তো তাঁরাও অনেকে ঘুরেফিরে ঢুকবেন সেখানে। সোশাল মিডিয়ার একটি বড় বৈশিষ্ট্যই তো ট্রেন্ডে গা ভাসানো। অন্যরা যা করছে, তা না করলেই ফোমো, অর্থাৎ পিছিয়ে পড়ার ভয়। সোশাল মিডিয়ার সেই ট্রেন্ডের দরুন যদি বই পড়ার ট্রেন্ডই খানিক বাড়ে, ক্ষতি কী!