প্রবাদ বলে, জল বিনে চাতক মৈল রে। কিন্তু মানুষের জন্যও যদি কখনও বরাদ্দ হয় তেমনই নিয়তি? গলা অব্দি শুকিয়ে যাওয়া তেষ্টায় যদি তাকেও জলের খোঁজে ফিরতে হয় কেবল? জলসংকট যখন ভয় ধরাচ্ছে আমাদের, সেই সময়ই সেই ক্ষত সারাতে এগিয়ে এসেছেন এই তরুণ। নিজেদের বাঁচানোর জন্য, জলাশয় বাঁচিয়ে রাখাই লক্ষ্য তাঁর। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
জলের আরেক নাম যে জীবন, এ কথা তো সেই ছোটবেলার পাঠ্য বইয়েই শেখা। কিন্তু বাস্তবে আর সে কথার প্রয়োগ ঘটল কই! জলের কলের মুখ খুলে রেখে জল অপচয় তো ঘটছেই, তার সঙ্গে জলাশয়ে আবর্জনা ফেলে, এমনকি পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট তুলে জলের প্রাকৃতিক উৎসগুলি নষ্ট করতেও আমরা উঠেপড়ে লেগেছি। যার জেরে অনিবার্য হয়েছে জলসংকট। আর এই সংকটের মুখেই প্রহরীর মতো এসে দাঁড়িয়েছেন এক যুবক। পৃথিবীকে ভালো রাখার জন্যেই লড়ছেন তিনি। যদিও একসময় তাঁর হাতে ছিল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি। তাতে মিলেছিল সুখের জীবনও। কিন্তু কেবল ব্যক্তিগত সুখ নয়, সকলের ভালো করার জন্য কোনও পথের সন্ধান করছিলেন আনন্দ মল্লিগাভাড় নামের এই যুবক। আর সে কারণেই জল সংরক্ষণ করার লক্ষ্য নিয়ে পথে নেমেছেন তিনি। সে কাজ করার জন্য চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন বেঙ্গালুরুর এই যুবক।
আরও শুনুন:
World Water Day: অবাক জলপান! জলের দরে আর মেলে না জল
দিনকয়েক আগেই একবিন্দু জলের জন্য হাপিত্যেশ করেছে বেঙ্গালুরু। সে শহর জুড়ে আগে ১৮৫০টি জলাশয় ছিল। বর্তমানে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫০-য়। কোনও জলাশয় জঞ্জালে ভর্তি, তো কোনওটা শুকিয়ে গিয়েছে। আসলে মানুষের অপরিণামদর্শিতার কারণে ছবিটা সর্বত্রই এক। এই অবস্থাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, কেবল নগরায়ণ বা নগরের সৌন্দর্যায়ন করেই মানুষের প্রাথমিক চাহিদাগুলিকে পূরণ করা যায় না। যে চাহিদা প্রকৃতি থেকেই মেটে, তার জন্য প্রকৃতিকে যত্ন করাটাও জরুরি। জরুরি প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি যত্নবান হওয়াও। সে কথাই মনে করান আনন্দ। তিনি মনে করেন, জলাশয়গুলি আসলে পৃথিবীর ফুসফুস। তাই আমরা যেমন নানা খাতে অর্থ বিনিয়োগ করি, জলাশয় সংরক্ষণের জন্য ঠিক তেমনটাই করা উচিত। কারণ এ থেকে যে ফিরতি লাভ মিলবে, তা আদতে আমাদের ভালো থাকা। তবে অন্য কে কী করবে, সে ভরসায় বসে না থেকে নিজেই এ কাজ আরম্ভ করে দিয়েছিলেন আনন্দ।
এখনও পর্যন্ত একশোর বেশি জলাশয় সংরক্ষণ করেছেন আনন্দ। চোল সাম্রাজ্যে যে পদ্ধতিতে জলাশয় পরিষ্কার করা হত, সেই একই পদ্ধতিতে তিনি কাজ করেন। কোনও জলাশয় পুনরুদ্ধার করতে চাইলে সেখানকার দূষিত, নষ্ট হয়ে যাওয়া জল খালি করে ফেলেন। তারপর প্রয়োজনে বাঁধ এবং খাল কাটা হয়। জলজ উদ্ভিদ আর অন্যান্য গাছ দিয়ে ছাউনি তৈরি করে জলাশয়ের এলাকায়। তারপর বৃষ্টির জল জমে সেই জলাশয় আবার প্রাণ ফিরে পায়। ২০১৭ সালে টাটা স্টিল সংস্থার তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান বি মুথুরামনের সঙ্গে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন আনন্দ। তারপর পুরোদমে শুরু করেন জলাশয় সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের কাজ। ২০১৯ সালে এর জন্যই মেলে RSSS পুরস্কার। আর সে বছরই চাকরি ছেড়ে সর্বশক্তি দিয়ে এ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন আনন্দ। শুধু জলাশয় পুনরুদ্ধার করাই নয়, এই সুবাদে জবরদখল করা ৯০ একর জমিও মুক্ত করেছেন তিনি।
আরও শুনুন:
যেখানে সোনম ওয়াংচুক নেই, সেখানে পরিবেশ বেশ আছে তো?
বোঝাই যাচ্ছে, এ কাজ শুনতে যতই বাহবা পাওয়ার মতো হোক না কেন, তাতে ঝুঁকিও কম নেই। আজকাল পুঁজির গ্রাসে জল-জমি-জঙ্গল সবই যেভাবে পণ্য হচ্ছে, তাতে পরিবেশের হয়ে লড়তে নাম্লে সেই পুঁজির সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য। তেমন হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন আনন্দও। তবে তাতে পিছু হটছেন না আনন্দ মল্লিগাভাড়। বরং মন দিয়ে এই দেশকে আর পৃথিবীকে ভালো রাখার কাজটাই করে যেতে চান তিনি, যে কাজের জন্য সকলে আজ তাঁকে ‘লেকম্যান’ বলেই চেনে।