কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম! এই ছিল দস্তুর। যে কোনও বড় অফিসের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। তবে, সম্প্রতি এক বড় সংস্থা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে অফিসে আর কোনও বস থাকবে না। তাতে কি কর্মীদের দক্ষতা বাড়বে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর থেকে সামান্য মোটাই ছিল কোম্পানির রুলবুক। পাতায় পাতায় নিয়ম। পদাধিকারীদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করা সেখানে। একটু বেচাল হলেই নম্বর কাটা। এদিকে পদে পদে নিষেধের ডোরে বাঁধা থাকতে থাকতে কর্মীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ফলে কাজের, বিশেষত উদ্ভাবনের দফারফা। কর্মীরা নিয়ম মানবেন নাকি নতুন সৃষ্টিতে জোর দেবেন? এগোলেও বিপদ, পিছোলে তো আর কথা নেই। প্রায় সারা বিশ্বেই অফিস জুড়ে এই শাঁখের করাত চলতে থাকে। প্রখ্যাত এক জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এত বসের বালাই রেখে কাজ নেই। বরং কর্মীরা সকলেই হয়ে উঠুন বস। অর্থাৎ নিজেরাই সামলান নিজেদের।
আরও শুনুন: শিল্পপতিরাও লজ্জা পাবেন! লোকসভায় প্রথম দফার সবথেকে ধনী প্রার্থীকে চেনেন?
কর্পোরেট দুনিয়ায় নতুন এই মডেল বেশ কয়েকটি ভাবনার পরিসর খুলে দিয়েছে। এযাবৎ একটি স্থির কাঠামোকেই কর্পোরেট সাফল্যের মূলমন্ত্র বলে মনে করা হত। সেখানে কাজের ভূমিকাও আলাদা হয়ে যেত। সেই নিরিখেই তৈরি হত পদের ধাপ বা ‘হায়ারার্কি’। তবে, এই সিস্টেমের একটি কুফল প্রায়ই আলোচনায় উঠে আসে। ধাপের গেরোয় পড়ে, কর্মীদের আর তাঁদের কাজের সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ থাকে না। পুরোটাই হয়ে ওঠে একটা কেজো যান্ত্রিক পদ্ধতি। অর্থাৎ কাজ, যা কিনা মূলত সৃষ্টি, তার থেকে কর্মীদের একরকম আত্মিক বিচ্যুতি দেখা যায়। তাঁরা কেবল নিয়মের দাস হয়ে নিয়মেরই সেবা করতে থাকেন। ফলত যখন উদ্ভাবনের প্রসঙ্গ আসে, তখন বিপদ ঘনিয়ে ওঠে। যা প্রত্যাশা করা হয়, আদতে তা হয় না। কেননা হরেদরে এক সংস্থায় সকলে কাজ করলেও, একটা কাজের প্রতি সকলের সমান যোগাযোগ থাকে না। অর্থাৎ যাকে বলা হয় ‘টিম’ তা প্রায়ই ভেস্তে যায়।
আরও শুনুন: টাকার দাম নেই! কেন শূন্য টাকার নোট চালু হয় দেশে?
আবার এ-কথাও ঠিক যে, একটা বড় সিস্টেম চালাতে গেলে নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকলে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে একটা সংঘবদ্ধতার প্রয়োজন হয় বইকি! তাতে নিয়মখাতা থাকা জরুরি। অফিস বিশ্বের যেখানেই হোক না কেন, সকল কর্মীরা একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে স্থির লক্ষ্যে কাজ করে গেলে উৎপাদন ব্যাহত হয় না। নিয়ম থাকা তাই যে একেবারে অমূলক, এমন কথা বলা যায় না। তবে প্রশ্ন সেখানেই। নিয়ম থাকে কীসের জন্য? কাজের পদ্ধতি মসৃণ করতে। তবে নিয়মই সর্বেসর্বা হয়ে যদি কাজ বা সৃষ্টিকে গিলে খায়, তবে তো ভারি মুশকিল। জার্মান এই সংস্থার বর্তমান সিইও এই ব্যাপারটা বেশ ভালো ভাবেই খেয়াল করেছিলেন। অফিসের মস্ত রুলবুক। আর তাই নিয়ে কর্মীরা তটস্থ। এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল তেমন ফিরছে না। বরং দিনে দিনে আয়ের গ্রাফ ক্রমশ পড়ছে। তারই অনুসন্ধান করতে গিয়ে কর্মীদের এই নিয়মভীতি খেয়াল করেন তিনি। আর তারপরই সিদ্ধান্ত নেন যে, ওরকম ঢাউস রুলবুক থাকারই দরকার নেই। যা ছিল তার প্রায় ৯৯ শতাংশই তিনি বাতিল করে দেন। যেটুকু না হলে নয়, সেটুকুই শুধু রাখেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন পদও তিনি মুছে দেন। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষিত এবং দক্ষ মানুষরাই আছেন এই সংস্থায়। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের সামলাতে পারেন। সংস্থার জন্য কী ভালো, কী মন্দ কী বিবেচনা করতে পারেন। তাহলে আর এত কিসিমের পদ, এত পদাধিকারী, এত নিয়ম-কানুন রাখার দরকার কী! কর্মীরা সকলেই সংস্থার প্রতি অনুগত, সেই ভালোবাসা থেকেই তাঁরা কাজ করবেন। উদ্ভাবনে জোর দেবেন। ভেবেই ক্ষান্ত থাকেননি। সেই কাজ তিনি করেও দেখিয়েছেন। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক পত্রিকায় তাঁর এই দর্শন খোলসা করে তিনি লিখেওছেন।
তাহলে কি এটিই হতে চলেছে আগামীর কর্পোরেট মডেল? সেদিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্বের বাণিজ্যপ্রভুরা। যদি এই পদ্ধতিতে সংস্থাটি আশানুরূপ উন্নতি করতে পারে, তাহলে এমন নিয়ম আরও অনেক সংস্থাই চালু করতে পারে। তাতে সংস্থা ও সংস্থার কর্মীদের সংযোগ বাড়বে বই কমবে না। নিয়ম যেমন জরুরি, তেমন অতিরিক্ত নিয়ম কি সংস্থার পক্ষে ক্ষতিকারকই! এই তর্ক নতুন নয়। তবে, সংস্থার এই পদক্ষেপে আবার নতুন করে সেই ভাবনার জায়গাটিই যেন খুলে গেল।