সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সঙকে সমাজের বিবেক বলেছিলেন। রঙ্গে ভরা সমাজে সে যেন ছিল চোখে আঙুল দাদা। উনিশ শতকে চড়ক-গাজনের সঙ্গে মিশে গেল সঙ। চৈত্র সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন মহল্লা থেকে সঙ বেরোত সেকালের কলকাতায়। কাঁসারিপাড়া, জেলেপাড়া, আহিরীটোলা, বেনেপুকুর ইত্যাদি পাড়ার সঙের নামডাক ছিল। ক্রমে তা অবলুপ্তির পথে হেঁটে গেল।
সঙের সেই ইতিহাসেই চোখ রাখলেন সৌভিক রায়।
ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্ষশেষের কলকাতায় অন্যতম সেরা আকর্ষণ ছিল সঙ। আদতে সঙ হল এক ধরনের শোভাযাত্রা, নানান রকম সেজে, অঙ্গ-ভঙ্গি করতেন সঙের কারবারিরা, বলা ভালো গাজন সন্ন্যাসীর দল। সঙ্গে থাকত ঢাক, ঢোল, কাঁসর ইত্যাদি বাদ্যি। বিচিত্র পোশাক পরে, রং মেখে সন্ন্যাসীরা গান গাইতেন, ছড়া কাটতেন। ঠেলাগাড়ির মতো একধরনের গাড়ি তৈরি হত সঙের শোভাযাত্রার জন্য, নাম দেওয়া হয়েছিল কাটরা গাড়ি। ঘোড়া, মহিষদের দিয়ে কাটরা গাড়ি টানানো হত। নানা পুজো, পার্বণ উপলক্ষে সঙ বেরোনোর রেওয়াজ ছিল।
এমনকী ধনীদের বিয়েতেও একদল লোক সঙ সাজত। উনিশ শতকে চড়ক-গাজনের সঙ্গে মিশে গেল সঙ। চৈত্র সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন মহল্লা থেকে সঙ বেরোত সেকালের কলকাতায়। কাঁসারিপাড়া, জেলেপাড়া, আহিরীটোলা, বেনেপুকুর ইত্যাদি পাড়ার সঙের নামডাক ছিল। সঙের গানে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, খোঁচা থাকত, বাবু শ্রেণির কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি, সমকালীন বিভিন্ন ঘটনাকে কটাক্ষও করা হত। পাশাপাশি সঙ হয়ে উঠেছিল সমাজের দর্পণ, অনেকটা চোখে আঙুল দাদার মতো। এজন্যই ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সঙকে সমাজের বিবেক বলেছেন।
কাঁসারিপাড়ার সঙ ছিল এদের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন। তারকানাথ প্রামাণিক এবং কৃষ্ণদাস পাল ছিলেন কাঁসারিপাড়ার সঙের দুই হোতা। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল জেলেপাড়ার সঙ। এই গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার অনেকটা কৃতিত্ব দিতে হয় লেখকদের, জেলেপাড়ার সঙ সমৃদ্ধ হয়েছে রূপচাঁদ পক্ষী, গোপাল উড়ে, রসরাজ অমৃতলাল বসু, দাদাঠাকুরদের লেখায়। জেলেপাড়ার সঙ ছিল দুর্গাচরণ কুন্ডুর ‘ব্রেন চাইল্ড’, ১৮৮২ সালে বউবাজারের জেলেরা এটি গড়ে তুলেছিল। ১৯০২-তে প্লেগ জাঁকিয়ে বসায় সেবার সঙ বন্ধ হয়ে যায়। ফের আরম্ভ হয় ১৯১৩-য়, জ্যোতিষচন্দ্র বিশ্বাস, ফকিরচাঁদ গড়াইরা তৈরি করেন জেলেপাড়া সঙ সংগঠন সমিতি। জেলেপাড়ার সঙ গোটা উত্তর কলকাতাকে (বলতে গেলে, উত্তর ও মধ্য কলকাতা) গোল করে ঘুরত, প্রথম প্রথম পদব্রজে, পরে অবশ্য গরুর গাড়ি জুটেছিল। প্রখ্যাত কবিরাজ রমানাথ কবিরাজের নামে তৈরি রমানাথ কবিরাজ লেন থেকে শুরু হত যাত্রা, তারপর অক্রূর দত্ত লেনের হয়ে ওয়েলিংটন স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যেত জেলেপাড়ার সঙ, এখন যেটা নির্মলচন্দ্র স্ট্রিট।
তারপর কলেজ স্ট্রিট ধরে এগিয়ে জেলেপাড়ার সঙ, মেছুয়াবাজার মোড়ে হল্ট নিত। চিৎপুর রোড থেকে আপার সার্কুলার রোড পর্যন্ত এলাকা তখন মেছুয়াবাজার নামেই পরিচিত ছিল। এরপরে সঙ এগোত আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে। তারপর বউবাজার পেরিয়ে নেবুতলা লেন, আজকের শশীভূষণ দে স্ট্রিট ধরে আবার রমানাথ কবিরাজ লেনে ফিরে আসত সঙ। গোটা উত্তর কলকাতাই ঘোরা হয়ে যেত।
জেলেপাড়া সঙের কয়েকটি উদাহরণ দিই।
যেমন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন চুরি হল, আর জেলেপাড়ায় সঙ বাঁধল। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাওয়া হতেই, সেকালের কনটেন্ট ক্রিয়েটাররা ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেবছরের চৈত্র সংক্রান্তির দিন জেলেপাড়ায় সঙ বেরোল–
‘বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে;
সখী নেকী নাকি পড়ল ফাঁকি
কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে।।
বিদ্যা সর্ব্ববিদ্যা অধিকারী
দেবের প্রসাদে গুমোর গো ভারী,
নইলে নারী হয়ে জয়ের জারি,
বিদ্যা নিত্য পূজে আশুতোষে,
থাকে উপোসে
চন্দ্রমোহন বদনখানি
ঘোমটা দিয়ে ঢাকেন রানী,
নিলেন বাইশ বুরুল
গুণসিন্ধুযুত নব যুব রায় এই শহরে
এখন ধূমকেতু তার ভাগ্যকাশে
মশান ভাসে নয়ন ঝোরে।।
গানের আড়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী, দেবপ্রসাদের পূর্বসূরি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রেজিস্টার পিজে বুরুল, অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার চন্দ্রভূষণ মৈত্রকে ব্যঙ্গ করা হল। এই সঙের লেখক কে জানেন? রসরাজ অমৃতলাল বসু। এটি আবার প্রবাসী পত্রিকায় বেরিয়েছিল, ১৩২৪ সনের বৈশাখে।
১৯৩১ সালে ব্রিটিশ বিরোধী সঙে লেখা হয়েছিল–
যেন কুঞ্জে আসে না লিখিত চতুর
বিলিতি বসন দে করে দূর
বিলিতি বেলোয়ারি কর লো চুর,
পুষো না পুষো না বিলিতি কুকুর
বিলিতি বাবুরে বাঁধ লো চেনে।
স্বদেশী আন্দোলনও উঠে এসেছিল সঙে–
বউমা আমার সেয়না মেনে চরকা কিনেছে
ঘরের কোণে আপন মনে সুতো কেটেছে।
পুরসভার সিদ্ধান্ত নিয়ে খোঁচাও দিয়েছে সঙ–
নিত্য নতুন চাচ্চে নেশন
দণ্ডে দণ্ডে ফিরছে ফ্যাশান
তাইতে ভাসান কর্পোরেশন
এপ্রেলেতে নতুন সেসন।
এই সঙ এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, সংক্রান্তির দিন কলকাতার বিত্তবানরা নিজেদের বাড়ির বারান্দা ভাড়া দিতেন সঙ দেখার জন্য। ছাদে শামিয়ানা টাঙানো হত। বাড়িতে আত্মীয় সমাগম হত। বাচ্চাদের জন্য দুধ, বড়দের জন্য শরবতের ব্যবস্থা থাকত। বাবু শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা সঙকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিল, কিন্তু তথাকথিত সম্ভ্রান্তদের কারণেই সঙের তাল কাটতে আরম্ভ করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে।
সঙ নিয়ে অনেক কাণ্ড হয়েছে কলকাতায়। অশ্লীল সঙের অভিযোগে কলকাতায় গাজন সন্ন্যাসীরা গ্রেপ্তারও হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগের পাহাড় জমতে জমতে ১৮২৭ সালে অশ্লীল সঙ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আইনকে কেয়ার না করে সেবারও চৈত্র সংক্রান্তিতে সঙ বেরোয়। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। সে খবর আবার ১৮২৭ সালের ২১ এপ্রিল তারিখের সমাচার দর্পণ-এ প্রকাশিত হয়। খবরে বলা হয়েছিল সন্ন্যাসীরা এমন সব অঙ্গভঙ্গি করেছেন, তা ভদ্রলোকে চেয়ে দেখতে পারবেন না। তিন-চারজন সন্ন্যাসীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। খবরের কাগজগুলো সঙের বিরুদ্ধে আসরে নেমেছিল, সমাজের মান্যগণ্যেরাও পিছিয়ে ছিলেন না।
সঙের কারবারিরা রীতিমতো পালটা হুঁশিয়ারি দিয়ে পথে নেমেছিল। ভাবখানা এমন ছিল, সঙ চলবেই। অশ্লীল মনে হলে দেখবেন না। তবে এমন মনোভাবও সঙকে রক্ষা করতে পারেনি। একে একে অবলুপ্তির পথে হেঁটেছে বিভিন্ন পাড়ার সঙ। ১৯৮০-তে তৈরি হওয়া কৈবর্ত সমিতির চেষ্টায় জেলেপাড়ার সঙ বিশ্বায়নের যুগেও টিকে গিয়েছিল।
নমো নমো করে হলেও, সে সঙ একালেও বের হয়। কালীঘাটেও সঙ বের হয়েছে গত বছর পর্যন্তও।
তথ্যঋণ:
বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গ – বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
সঙের সেকাল-একাল – স্বপন বক্সী