যে ভারতবর্ষ একসময় ছিল, পুরনো পুথি-লেখ-লিপিতে যে ভারতবর্ষের সন্ধান মেলে, অথচ যা ক্রমশ বদলে গিয়েছে, রাহুলের যাত্রা জুড়ে সেই দেশের সন্ধান করা যায়। তিনি দেখেছিলেন সেই বহুমাত্রিক ভারতকে, খানিক অন্তর অন্তর যার মুখের ভাষা, গায়ের বসন, রোজকার যাপন পালটে যেতে থাকে। আর সেই সমস্ত বদল একসঙ্গে ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকে একটাই দেশ, যার নাম ভারতবর্ষ। সেই দেশকে নানাভাবে ছুঁয়েছেনে দেখে, সেই অভিজ্ঞতাকে ক্রমাগত লিখে গিয়েছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন।
সেও যেন একরকমের ভারত জোড়ো যাত্রা। দেশকে দেখতে দেখতে, দেশের মানুষকে দেখতে দেখতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেশের প্রকৃত স্বরূপটিকে চিনতে চাওয়া। সে যাত্রায় অবশ্য কোনও রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল না। একান্ত শিক্ষার্থীর চোখ দিয়েই সেদিন নিজের দেশকে চিনছিলেন রাহুল। শিক্ষার্থী হয়েই তো নেমেছিলেন পথে। সরকারি বৃত্তির অভাবে উর্দু মিডল স্কুলের পরে আর পড়া হয়নি। কিন্তু তেরো বছর বয়সে উত্তরপ্রদেশের ঘর ছেড়ে বেরোনো, সেখান থেকে কলকাতায় পৌঁছে যাওয়া, রুটিরুজির সন্ধানে নানারকম জীবিকায় নিজেকে জুড়ে নেওয়া, এ সবকিছুই তাঁকে জীবনের পাঠ শেখাচ্ছিল। সেই জীবনই পরিবার ছাড়িয়ে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল বিহারের মঠে। মিলেছিল পড়াশোনার সুযোগ। কিন্তু তাতেও মন ভরেনি যেন। সংস্কৃত শাস্ত্র নিয়ে পড়তে চান বলে পরে দক্ষিণ ভারতের তিরুমিশি-র উদ্দেশে যাত্রা করেন রাহুল। আর সে যাত্রার অনেকটাই পায়ে হেঁটে। এই দীর্ঘ যাত্রায় দেশ চিনলেন রাহুল। দেখলেন সেই বহুমাত্রিক ভারতকে, খানিক অন্তর অন্তর যার মুখের ভাষা, গায়ের বসন, রোজকার যাপন পালটে যেতে থাকে। আর সেই সমস্ত বদল একসঙ্গে ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকে একটাই দেশ, যার নাম ভারতবর্ষ। সেই দেশকে নানাভাবে ছুঁয়েছেনে দেখে, সেই অভিজ্ঞতাকে ক্রমাগত লিখে গিয়েছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন।
আরও শুনুন :
অপারেশনের ব্যথা ভোলানো রবীন্দ্রনাথ নিজেই যেন বিশল্যকরণী
আসলে এমনই বহুমাত্রিকতাই তো ভারতের প্রাণের কথা ছিল। সে ভারতকে এখন হয়তো আমরা আর চিনে উঠতে পারি না। কিন্তু যে ভারতবর্ষ একসময় ছিল, পুরনো পুথি-লেখ-লিপিতে যে ভারতবর্ষের সন্ধান মেলে, অথচ যা ক্রমশ বদলে গিয়েছে, রাহুলের যাত্রা জুড়ে সেই দেশের সন্ধান করা যায়। আবার সেই দেশকে দেখার চোখও বদলেছে তাঁর। শুধু শিক্ষার্থীর চোখে নয়, সমাজসম্পৃক্ত রাজনীতিকের চোখেও ভারতকে তিনি দেখেছিলেন বইকি। দেশের রাজনীতিও তখন এক জরুরি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার লক্ষ্যে যুঝছে পরাধীন দেশ। কলকাতা শহর তাঁকে যেভাবে রাজনীতি সচেতন করে তুলেছিল, সেই সচেতনতা তাঁকে পরবর্তীতে ঠেলে দেয় সরাসরি রাজনীতির শরিক হতে। যে বিহারে একসময় সন্ন্যাসী হয়ে মঠে শিক্ষা নিয়েছেন, সেই বিহারেই রাহুল কাজ শুরু করলেন কংগ্রেসের কর্মী হিসেবে। যেতে হল জেলেও। কারাগারে বসেও কিন্তু দেশকে খুঁজে চলা থামেনি তাঁর। ভারতে বৌদ্ধদের পুনরভ্যুত্থান হল কেমন করে, কখনও ফা-হিয়েনের ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়ে, কখনও পালিতে লেখা বৌদ্ধ গ্রন্থ পড়ে তা বুঝে নিচ্ছিলেন রাহুল। পরবর্তীতে এই খোঁজ করতেই রাহুল চারবার তিব্বত গিয়েছিলেন, কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই। সেই একাকী অভিযানে আসলে উঠে এসেছিল ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেকগুলি হারিয়ে যাওয়া পাতা। যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবর্তন পরবর্তী কালে উঠে আসবে তাঁর মহাকাব্যিক রচনা ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’-য়। আবার একই বিবর্তনের ইতিহাস জেগে থাকবে তাঁর ধ্রুপদি মার্ক্সীয় গ্রন্থ ‘মানব সমাজ’-এ। যেমনভাবে তাঁর দেখা ভারতবর্ষের স্বরূপ ধরা পড়েছিল তাঁর ‘মেরি জীবন যাত্রা’ বইয়ে।
আরও শুনুন :
ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বললেই কণ্ঠরোধ! নতুন নয়, ভুগতে হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনচন্দ্রকেও
আসলে দেশের শিকড়কে খুঁজতে হলে যে তার সংস্কৃতিকে খুঁজে দেখতে হয়, সহিষ্ণু চোখে স্বীকার করতে হয় তার যাবতীয় ভিন্নতা ও বিবর্তনকে, সে কথা বুঝেছিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। আর সেই ভিন্নতায় যে আরও একাধিক সংস্কৃতির আদানপ্রদানও লেগে থাকে, সে কথাও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নিজের দেশের পাশাপাশি অন্য দেশ দেখার অভিজ্ঞতা দিয়ে। এই সমস্ত দেখা মিলিয়েই এমন এক ভারতবর্ষের খোঁজ তিনি রেখে গিয়েছেন, দেশকে একমাত্রিক করে দেখার যাবতীয় অসহিষ্ণুতার মধ্যে যা পালটা বয়ান হয়েই জেগে থাকতে পারে।