শরীরে কাটাছেঁড়া নিয়ে ভয় ছিল রবীন্দ্রনাথের। অথচ সম্প্রতি এক অস্ত্রোপচারের সময় সহায় হয়ে উঠলেন তিনিই। সম্পূর্ণ অজ্ঞান না করে, তাঁর কবিতা-গল্পে ভুলিয়ে রাখা হল রোগীকে। এল কাঙ্ক্ষিত সাফল্যও। রবীন্দ্রনাথ আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর মতো উপশম বুঝি আর নেই বাঙালির। বাঙালির একান্ত সেই বিশল্যকরণীর কথা লিখলেন সরোজ দরবার।
যন্ত্রণার বদ্ধ গড়ের ভিতরও অন্তরে একটুকু আকাশ বেঁচে থাকে বলেই নন্দিনী শুনতে পেত বিশুপাগলের গান। বাঙালির কাছে সেই আকাশ রবীন্দ্রনাথ। স্বয়ং স্রষ্টার বিশ্বাস ছিল, বিশেষ করে বাঙালির ক্ষেত্রেই, “শোকে দুঃখে, সুখে আনন্দে, আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। যুগে যুগে এ গান তাদের গাইতেই হবে।” স্থায়িত্বের সে বিশ্বাস ব্যর্থ হয়নি। তবে শুধু গান নয়; যত যুগ বদলেছে, কাল বদলেছে, দেখা গিয়েছে বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথই হয়ে উঠেছেন যন্ত্রণামুক্তির অমোঘ বিশল্যকরণী। এমনকী রবীন্দ্রনাথ ভুলিয়ে দিতে পারেন শারীরিক যন্ত্রণাও।
-: আরও শুনুন :-
শস্যের রূপকে রাম-সীতা ভাই-বোন, রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ মানুষের যন্ত্রণার কাব্য
সম্প্রতি বছর আষ্টেকের এক খুদের চোখে অপারেশন করতে হয়েছিল। নানা কারণেই তাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করার পথে হাঁটেননি চিকিৎসকরা। অস্ত্রোপচারের জন্য যা যা দরকার সেই ব্যবস্থা করা হয়। আর সহায় হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। অপারেশনের সময় সিস্টার খুদেকে শোনাতে থাকেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। গল্পও করতে থাকেন অনর্গল। সফল হয় অপারেশন। আর শেষে তাই স্বয়ং কবিগুরুকেও ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি চিকিৎসকরা। রবীন্দ্রনাথের গান যে যন্ত্রণা-অবসাদ মুছিয়ে দিতে পারে, সে প্রমাণ আগেও মিলেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে উইলফ্রেড আওয়েন-এর কাছে থাকা গীতাঞ্জলি তেমনই এক ব্যথা ভোলানোর উপশম হয়ে ছিল। আসলে সুর তো আদতে ফকির। তবে যন্ত্রণামুক্তির অসীম ক্ষমতা আছে সুরের বাঁধনেই। বাঙালির কাছে সেই মুক্তি নিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথই। তিনি অবশ্য নিজের ক্ষেত্রে শারীরিক কাটাছেঁড়ার তেমন পক্ষপাতী ছিলেন না। শেষ বয়সে যখন তাঁর অপারেশন করা হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন স্বয়ং কবি অপারেশনের বিপক্ষেই ছিলেন। তবে, এ কথা ঠিক, বাঙালির অপারেশন থিয়েটারে বহুবারই সহায় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মূলত তাঁর গানের আশ্চর্য ক্ষমতায়। যে গানকে অমিয় চক্রবর্তী বলেছিলেন ‘প্রাণের সঙ্গে পৃথিবীর সেতু’, সেই গানই বাঙালিকে দিয়েছে যন্ত্রণা পেরনোর সেতু। সাম্প্রতিক ঘটনা যেন বলল, শুধু গান নয়, কবিতাতেও তা সম্ভব। বাংলা কবিতার বর্তমান আধুনিক পথ কি আর সেভাবে রবীন্দ্রকবিতার ভুবনের দিকে ফিরে তাকায়! সে প্রশ্ন কবির হতে পারে, কবিতা সমালোচকের হতে পারে। তবে, কবিতার আধুনিকতা এখানে বিবেচ্য নয়। আলোচ্য হয়ে উঠছে বাঙালি মনন ও রবীন্দ্রনাথের নিবিড় সখ্য। অর্থাৎ গান-কবিতার আঙ্গিকগত ভেদ থেকেও এখানে থেকেও মুখ্য হয়ে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং।
-: আরও শুনুন :-
রবীন্দ্রনাথ যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত নির্বাচনী ইস্তাহারে?
কোন রহস্যে যন্ত্রণামুক্তির পথ বাঙালিকে বাতলে দিতে পারেন রবীন্দ্রনাথ? ডা. সব্যসাচী সেনগুপ্ত, যিনি সাহিত্যক্ষেত্রেও সুপরিচিত, তিনি বলছেন, “যে কোনও যন্ত্রণামুক্তি বা ব্যথামুক্তির কথা যদি বলি, সেটা দুরকম ভাবে হতে পারে। এক, সেই জায়গাটিকে অবশ করে দেওয়া। অথবা, মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। এই যে মনটাকে সরিয়ে দিয়ে ব্যথা পেরিয়ে যাওয়ার শক্তি, তা কোনও সুখস্মৃতি বা সুখকর শব্দও দিতে পারে। সুন্দর একটা মুহূর্ত বা গান, সুন্দর কথা রোগীকে অবশ্যই আরাম দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ব্যথার ইন্টেনসিটিরও মাথায় রাখতে হবে। কতটা ব্যথা কেউ এভাবে অতিক্রম করতে পারেন, তা ব্যক্তিবিশেষে আলাদা হয়ে যায়। যেমন অ্যানাস্থেশিয়ার মাত্রাতেও তারতম্য ঘটে।”
আর রবীন্দ্রনাথ? ডাক্তারবাবু বলছেন, “একথা অনস্বীকার্য যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গান- যদি কান সেই ভাবে তৈরি থাকে – তবে নিশ্চিতই উপশম হয়ে উঠতে পারে। যিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গান কখনও শোনেননি, তিনি হয়তো কয়্যার সংগীতে এই জায়গাটা খুঁজে পাবেন বা অন্য কিছুতে। এই সাংস্কৃতিক ভিন্নতাও মাথায় রাখা জরুরি। এবার যদি বাঙালির কথাতে আসি, বিশেষত সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির কাছে, অবধারিত ভাবেই সেই আশ্রয় হয়ে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ। সংস্কৃতিমনস্ক বলতে আমি একটা গড় ধারণার কথাই বলছি। এমন বাঙালিও থাকতে পারেন, যাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথের থেকেও তাঁর এলাকার স্থানীয় কোনও সুর হয়তো এই কাজটা করতে পারে। তবে, ওই তথাকথিত সংস্কৃতিমনস্কতার কথা ধরলে, ব্যথামুক্তির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সবার উপরেই থাকবেন। এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই।”
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বাঙালির মনন যেভাবে তৈরি তাতে যন্ত্রণামুক্তির পথও যেমন তিনি, পাথেয় জোগাচ্ছেনও তিনি। সংস্কৃতিমনস্কতার একটা গড় ধারণা কল্পনা করে নিলেও, চোখে পড়ে, সেখানে রবীন্দ্রছায়া বহুদূর প্রসারিত। আর তাই বোধহয় শহর বা শহর ছাড়িয়ে, বয়স পেরিয়ে প্রায় যে কোনও বাঙালিকেই ব্যথা পেরনোর শক্তি দিতে পারেন রবীন্দ্রনাথ, দিচ্ছেনও। শারীরিক ব্যথা শুধু নয়; সময়ের মারে যখন আমরা সংকটের মুখোমুখি হই, জাতীয়তাবোধের চড়া রোদে ক্লান্ত হয়ে মানুষের সন্ধান করি, তখনও সামনে এগিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথই। তাঁর গান, গদ্য, প্রবন্ধ, সংগঠন- সবকিছু নিয়েই। তাঁর দর্শন ছাড়া বাঙালির ভবিষ্যৎ-দর্শন তাই পূর্ণতা পায় না। বাঙালির জাতিসত্তার সমবেত জাগরণের তিনিই অলখ সুতো; অতীতে, বর্তমানে, ভবিষ্যতেও। আর তাই সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে বাঙালি তাঁর কাছেই ফিরে যেতে পারে। আর তিনি দেন বজ্রানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলোর শক্তি। ব্যথা থেকে পৌঁছে দেন ব্যথামুক্তির অগম পারে।
ব্যথার ভিতর ঘুমিয়ে পড়ার আগে তাই না বলে উপায় কী যে, ভাগ্যে বাঙালির একজন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন!