আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পরামর্শে খোলা হয়েছিল শরবতের দোকান। কেবল ব্যবসাই নয়, এর নেপথ্যে ছিল জাতীয়তাবাদের আদর্শও। আজও সগৌরবে চলছে সেই প্যারামাউন্ট। শুনে নেওয়া যাক।
গরম পড়লেই শরবতের জন্য প্রাণ ছটফট করে ওঠে আমাদের। নানা রঙের, নানা স্বাদের ওই এক গ্লাস জলেই যেন তখন অমৃতের আস্বাদ। সেই স্বাদু পানীয়ের মধ্যেই পুষ্টিগুণ মিলিয়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন এক বাঙালি। কথায় কথায় চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলা নিয়ে ঘোর বিতৃষ্ণা ছিল তাঁর। বদলে পরাধীন দেশের ছেলেছোকরাদের স্বাস্থ্য রক্ষার কথা ভেবে আরেকরকম পানীয়ের জোগান দেওয়া উচিত, এই ছিল তাঁর মত। তিনি আর কেউ নন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বাঙালি ব্যবসা করুক, আজীবন এই স্বপ্ন যিনি দেখে গিয়েছেন। তিনিই এক বাঙালি যুবককে পরামর্শ দেন, একইসঙ্গে পেট ভরবে, পুষ্টিও হবে, এমন শরবত বানাতে। হ্যাঁ, পরাধীন ভারতে দাঁড়িয়ে নীহাররঞ্জন মজুমদারকে ব্যবসার বুদ্ধিটি জুগিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আর সেখান থেকেই শুরু হয় প্যারামাউন্টের বিখ্যাত ডাব শরবতের পথচলা। ১৯১৮ সালে অবশ্য ‘প্যারাডাইস’ নামে দোকান খুলেছিল। ১৯৩৭-এ তার নাম বদলে যায় ‘প্যারামাউন্ট’-এ। একসময় কেবল গ্রীষ্মকালেই নাকি ঝাঁপ খুলত তার। তবে চাহিদার কথা মাথায় রেখে দ্রুতই সারাবছর ধরে ব্যবসা বিছিয়ে ফেলে প্যারামাউন্ট। আর শরবত তৈরি করে শহরকে আজও ঠান্ডা রাখে সেই তরল-তীর্থ।
আরও শুনুন:
লেখায় পারিশ্রমিক ছবি, সিনেমায় কী করতেন সত্যজিৎ? ফাঁস করলেন ‘অপু’র নায়িকা
তবে প্যারামাউন্ট কিন্তু শুধুমাত্র ব্যবসা নয়, এর সঙ্গে জুড়ে ছিল জাতীয়তাবাদের আদর্শও। সে কথা জানায় দোকানের হলুদ বোর্ডখানাই। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, মানবেন্দ্রনাথ রায় থেকে স্বদেশি যুগের একরোখা বিপ্লবীদের নাম লেখা তাতে। বাঙালির জাতীয়তাবাদী অহংকার একাকার ‘প্যারামাউন্ট’-এর ব্র্যান্ড-গরিমার সঙ্গে। শোনা যায়, বরিশালের বিপ্লবী, তরুণ সতীন সেনের সঙ্গে শিয়ালদহে নেমেছিলেন নীহাররঞ্জন। পকেট প্রায় ফাঁকা। কিন্তু বুকে ভরপুর স্বদেশপ্রেম। স্বদেশি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নীহাররঞ্জন হামিদা পালোয়ানের আখড়ায় কুস্তি শিখতে শুরু করলেন। পুলিনবিহারী দাসের কাছে লাঠিখেলায় দীক্ষা। এর মধ্যে শরবতের ব্যবসা শুরু হল বটে, কিন্তু সেই দোকানও হয়ে থাকল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গোপন আস্তানা। দোকানের সামনের দিকে শরবতের পসরা, আর পিছনের যে অংশে শরবত বানানো হয় সেখানেই এসে আশ্রয় নিতেন বিপ্লবীরা।
আরও শুনুন:
খোলা পিঠই বাংলা সংস্কৃতির ‘পীঠস্থান’! তবে বানান ভুল শুধরোবে কে?
আসলে সেই পরাধীন দেশে ব্যবসা হয়ে উঠেছিল আত্মনির্ভরতার পথ। নিজেকে শুধু নয়, দেশকে আত্মনির্ভরতার শক্ত মাটিতে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন এই মানুষেরা। তাই তাঁদের কাজেও জুড়ে ছিল দেশ ও তার মানুষের প্রতি ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসার ইতিহাসই ধারণ করে আছে শতাব্দীপ্রাচীন এই সংস্থা।