ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে কোনও খেলোয়াড় ফর্মে না থাকলেই তাঁর উদ্দেশে ধেয়ে আসে সমর্থকদের বাক্যবাণ। আক্রমণের নিশানায় পড়েন খেলোয়াড়দের স্ত্রী বা প্রেমিকাও। আবার সোশাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম হাতের নাগালে থাকায় সেখানেও কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন সমর্থকরা। কিন্তু এবার আর ভারচুয়াল জগতে নয়, বাস্তবেই রক্তক্ষয়ী সংঘাত দেখল ক্রিকেট। মহারাষ্ট্রের এই মর্মান্তিক ঘটনা যেন আরও একবার প্রশ্ন তুলে দিল, নিছক খেলার মধ্যেও কি তবে শক্তি আর ক্ষমতার গর্জনই বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
ভদ্রলোকের খেলা বলেই নামডাক ছিল ক্রিকেটের। কিন্তু মাঝমাঠের খেলা যে কখন সত্যিই লড়াইয়ের তকমা পেয়ে গেল, আর সেই লড়াই মাঠের বাইরেও এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে আক্রমণের নিশানায় এসে পড়লেন খেলার মাঠের বাইরে থাকা দর্শকেরাও, তা বোধহয় আমরা খেয়ালও করিনি। আমাদের সেই বেখেয়ালের সুযোগেই খেলার প্রতি ভালোবাসা টেনে আনল অসহিষ্ণুতাকে। এক পক্ষের ভালোবাসা অন্য পক্ষের ভালোবাসাকে মেনে নিতে পারল না, আর সেখান থেকেই সমর্থকদের দুই পক্ষের মধ্যেও টানা হয়ে গেল বিভাজনের রেখা।
আরও শুনুন:
পিঠেতে টাকার বোঝা, তাই জরুরি স্টার্কের উইকেট খোঁজা?
সত্যি বলতে, ফুটবলের মাঠে এ ছবি তেমন অপরিচিতও ছিল না হয়তো। সেই কবে থেকেই তো ইস্ট-মোহন বিবাদের মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঁটাতার। দেশভাগের রক্তাক্ত ইতিহাস ভুলে উদ্বাস্তুদের কটাক্ষ করতে বাধে না ডার্বির ময়দানে। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট এই ডার্বির মাঠেই ভয়ংকর সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন দু’দলের সমর্থকেরা। যার ফলশ্রুতিতে ঝরে গিয়েছিল ১৬টি প্রাণ। কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে নিজের দলকে নিয়ে পক্ষপাত থাকলেও তার বহিঃপ্রকাশে খানিক লাগাম টানা ছিল গোড়ার দিকে। একে বিলিতি খেলা, তায় প্রথম দিকে ধনী অভিজাতদের নাগালেই থাকা ক্রিকেটে হইচই থেকে হাতাহাতি, কোনও কিছুই তত সুলভ ছিল না। তবে সেই আভিজাত্যে টান পড়েছে অনেকদিনই। বিশেষ করে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে কোনও খেলোয়াড় ফর্মে না থাকলেই তাঁর উদ্দেশে ধেয়ে আসে সমর্থকদের বাক্যবাণ। আক্রমণের নিশানায় পড়েন খেলোয়াড়দের স্ত্রী বা প্রেমিকাও। আবার সোশাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম হাতের নাগালে থাকায় সেখানেও কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন সমর্থকরা। কিন্তু এবার আর ভারচুয়াল জগতে নয়, বাস্তবেই রক্তক্ষয়ী সংঘাত দেখল ক্রিকেট। রোহিতের আউট নিয়ে কেন উল্লাস প্রকাশ করেছেন, এই অপরাধেই রীতিমতো মার খেতে হল এক ব্যক্তিকে। বন্ধু ও বন্ধুর ভাইপোর হাতে বেধড়ক মার খেয়ে মৃত্যু হয়েছে ৬৩ বছরের ওই ব্যক্তির। মহারাষ্ট্রের এই মর্মান্তিক ঘটনা যেন আরও একবার প্রশ্ন তুলে দিল, নিছক খেলার মধ্যেও কি তবে শক্তি আর ক্ষমতার গর্জনই বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
আরও শুনুন:
চোটের দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে রাজকীয় কামব্যাক, জীবনের লড়াইয়ের মন্ত্রই শেখাচ্ছেন ধোনি-পন্থ
ক্ষমতা, সে ছোট বড় যাই হোক না কেন, সে আসলে সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দিতেই চায়। আর দুই ক্ষমতার লড়াইয়ের মাঝে কোল্যাটারাল ড্যামেজ হয়ে ঢুকে পড়ে নারী, শিশু, কিংবা উলুখাগড়ার মতো নিছক ক্ষমতাহীন কিছু মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই প্রবণতা রাষ্ট্রের হতে পারে, হতে পারে যে কোনও ক্ষমতাকেন্দ্রেরও। কিন্তু খেলা, বিশেষ করে দলগত খেলা, তার তো এমন কোনও দায় ছিল না। বরং এ কথাই কি সত্যি নয় যে, আসলে যে কোনও খেলারই একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষকে জুড়ে থাকতে শেখানোর কথা ছিল? এই নিষ্ঠুরতার দুনিয়ায়, একজন মানুষের পাশ থেকে আরেকজনের মসৃণভাবে সরে যাওয়ার দুনিয়ায়, মানুষকে বেঁধে থাকতে শেখানোরই কি কথা ছিল না খেলার? সেখানে কখন যেন খেলার সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়াল লড়াই। শত্রুকে দুরমুশ করে দেওয়া। আর সেই শত্রুতার বয়ানে চুপিচুপি মুছে গেল খেলোয়াড়ি বেঁধে থাকার গল্পগুলো। বদলে জেগে উঠল তীব্র, হিংস্র হুংকার। সে হুংকারের নিশানা কেবল প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরাই নন, খেলোয়াড়দের পরিবার, এমনকি খেলার মাঠের বাইরে থাকা দর্শকেরাও। বাইরের দুনিয়ায় নানারকম ভাবে যে অসহিষ্ণুতার ছবি দেখা যাচ্ছে, সেই হিংসার ছাপ যেন এসে পড়ছে দলগত খেলার মাঠেও। সেই আশঙ্কার কথাই উসকে দিল মহারাষ্ট্রের এই ঘটনা।