নারীর ইতিহাস থেকে সাম্প্রতিকের অনুক্ত দিনপঞ্জি লিখে যেতে চেয়েছিলেন মল্লিকা, নিজের গোটা লেখালিখির পাতা জুড়ে। কি কবিতায়, কি গদ্যে, সেই স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ করাই ছিল তাঁর নিজস্ব গন্তব্য। মেয়েদের যাবতীয় বলা আর না-বলাকে নথিভুক্ত করে রাখতে চেয়েছিলেন বলেই খনা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি কবি লেখক মহিলাদের প্রান্তিকায়নের গোপন প্রতীকী আইকন। লিখছেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
যে মেয়েদের কথা বলার অধিকার থাকে না, তাদের হয়েই আজীবন কথা বলতে চেয়েছিলেন মল্লিকা। তিনি মনে করতেন, খনা যেদিন বচন লেখা শুরু করলেন সেই মুহূর্ত থেকেই বাঙালি মেয়েদের কবিতা লেখা শুরু, যে খনার খ্যাতি সহ্য করতে না পেরে স্বামী ও শ্বশুর মিলে তার জিভ কেটে নিয়েছিল মধ্যযুগের বাংলায়। সেই নিষ্ঠুর কিংবদন্তির দিকে তাকিয়ে মল্লিকা বুঝে নিয়েছিলেন, একজন মেয়েকে এইভাবে যে বোবা করে দেওয়া হল, তা কোনও ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা মাত্র নয়। তাঁর কাছে এ ঘটনা ছিল বাঙালি মেয়েদের কণ্ঠরোধের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আর ‘পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল’, এই চেতনার আলোকেই তিনি সেই প্রক্রিয়াকে যাচাই করে চলেছিলেন ক্রমাগত। খুঁড়ে দেখতে চেয়েছিলেন সেইসব কথামানবীদের ভিন্ন ভিন্ন যাপন, যাদের কেউ কথা বলতে চেয়ে শাসনের মুখে পড়েছে, কেউ সেই মারের মুখের উপর দিয়ে গলা তুলেছে, কেউ আবার কথা বলার স্বরটিই খুঁজে পায়নি। সত্যি বলতে, যে পাখি খাঁচার বাইরের দুনিয়াটা চেনে না, সে তো খাঁচাকেই সত্যি বলে জানে। যে নারীরা কেবল লিঙ্গপরিচয়েই নন, ভৌগোলিক পরিচয়েও প্রান্তিক, সামাজিকভাবেও অপর, তাঁরা অনেকেই হয়তো কথা বলার তাগিদটুকুই জানেন না। নারীর সেই স্তরকে অন্তরঙ্গভাবে চেনারই কথা ছিল সমাজবিদ্যার ছাত্রী ও অধ্যাপক মল্লিকা সেনগুপ্তের। আর কি কবিতায়, কি গদ্যে, সেই স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ করাই ছিল তাঁর নিজস্ব গন্তব্য। কেবল তাঁর সময়ের মেয়েদের কথা নয়, আবার তাঁর আগেকার মেয়েদের ফেলে আসা গল্পও নয় কেবল, ইতিহাস থেকে সাম্প্রতিকের অনুক্ত দিনপঞ্জি তিনি লিখে যেতে চেয়েছিলেন নিজের গোটা লেখালিখির পাতা জুড়ে।
-: আরও শুনুন :-
মেয়েদের রামায়ণ কেমন? সীতার চোখ দিয়েই ক্ষমতার ওপিঠে আলো ফেলেছিলেন নবনীতা
মল্লিকা নিজেই বলেন, “একটি মেয়ে খানাখন্দ গ্রামপথে লণ্ঠন হাতে নিয়ে বয়স্ক ইস্কুলে অ আ ক খ শিখতে চলেছে, পালিয়ে যাওয়া বরকে চিঠি লিখবে বলে। এক মহীয়সী বছরের পর বছর নর্মদার তীরে দাঁড়িয়ে মহাবাঁধ প্রকল্পে উৎখাত হতে থাকা মানুষদের জন্য লড়াই করছে। একজন মহাকাব্যের নায়িকা আড়াই হাজার বছর আগে দণ্ডকারণ্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিরস্ত্রীকরণের কথা বলেছিল। এরাই আমাকে কবিতা লিখতে শিখিয়েছে; আমার কবিতা ভুলে যাওয়া, উপেক্ষিত, ইতিহাস বিলুপ্ত এইসব মেয়েদের সুখদুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা বিশ্বাসভঙ্গ নিগ্রহ যন্ত্রণার অভিব্যক্তি।” মেয়েদের এইসব বলা আর না-বলাকে নথিভুক্ত করে রাখতে চেয়েছিলেন বলেই খনা তাঁর কাছে হয়ে ওঠেন বাঙালি কবি লেখক মহিলাদের প্রান্তিকায়নের গোপন প্রতীকী আইকন।
-: আরও শুনুন :-
‘মেয়েলি লেখিকা’ তকমা নিয়েই আশাপূর্ণা তুলে ধরেছিলেন রুদ্ধস্বরের কথকতা
আসলে কেবল প্রান্তিক মেয়েদের তো নয়, মূলধারায় থাকা নারীদেরও যে পুরুষশাসিত ক্ষমতাকেন্দ্রে অনেকসময়ই প্রান্তিক হয়ে যেতে হয়, মল্লিকা তা জানতেন। তিনি তো কেবল কবি নন, তিনি কবিতার ইতিহাসে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলেন, পাশাপাশি সমাজবিদ্যার নিবিড় গবেষকও তিনি। তাই তাঁর চোখ এড়ায় না, কীভাবে কবিতা সিংহের শোকসভায় তাঁর প্রেম ও সৌন্দর্যের বর্ণনা লেখাকে ছাপিয়ে ওঠে। সেই ‘রাগী যুবতি’ কবিতা সিংহ, স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালি কবিদের মধ্যে প্রথম উচ্চারিত নারীবাদী কবি। মল্লিকা বিশ্লেষণ করেন, হয়তো সেই কারণেই ‘পুরুষের-চোখে-লেখা বাংলা কবিতার বলয়ে তিনি ছিলেন প্রান্তিক ও ভূমিহারা’। সেই ইতিহাসের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে মল্লিকা বলেন, “আমরা, পরবর্তী বাঙালিনী কবিরা প্রচুর লড়াই করে পায়ের তলায় একটু মাটি জোগাড় করেছি, ফলে আমরা নিজেদের আর বাংলা কবিতার কেন্দ্র-স্বর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করি না। তবে মূল কেন্দ্রের সঙ্গে থেকেও মেয়েদের পাড়ায় পাড়ায় আমরা একটা নিজস্ব স্পেস তৈরি করে ফেলেছি, নিজেদের মধ্যে কথা বলার, নিজেদের কথা শোনার একটা মানবী-ক আড্ডা, যেসব কথা পুরুষ সঙ্গীরা শুনতে চায় না তেমন অনেক নীরব কথায়, নিঃশব্দ উচ্চারণে মুখর সেই স্পেস।” তাই কবিতায় মল্লিকা প্রশ্ন তুলে যান, “গৃহশ্রমে মজুরি হয় না বলে মেয়েগুলি শুধু/ ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে/ আর কমরেড শুধু যার হাতে কাস্তে হাতুড়ি!” কেবল কবিতার অক্ষরে কুলোয় না বলেই গদ্যের শানিত বয়ানেও সেই নির্বাসিত প্রান্তিক মানুষদের কথাই তিনি বলে যান ক্রমাগত। তাঁর ‘সীতায়ন’ উপন্যাসে আর্য রাষ্ট্রতত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন সীতা, আবার অসুস্থ মল্লিকার কলমে ‘কবির বউঠান’ উপন্যাস হয়ে থাকে ঠাকুরবাড়ির বিনির্মাণ। এ লেখা সেই মল্লিকা লেখেন, যিনি ‘রেখেছ রমণী করে’ প্রবন্ধে এ কথা বলতে দ্বিধা করেননি, “নারীকে ভালবাসতে গিয়ে নারীর সর্বনাশটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই করে গিয়েছিলেন। যে রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন, তিনিও কিন্তু নারীর সমকক্ষতা চাননি।” তিনটি উপন্যাস এবং তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ, এটুকুই মল্লিকার গদ্য উদযাপন। আর গদ্যপদ্যপ্রবন্ধ মিলে সেই সমস্তটিই আদতে একটি দীর্ঘ চেতনাপ্রবাহ, একটি অবশ্যপাঠ্য মানবীবিদ্যার ভাষ্য, নিজের জীবন ব্যয় করে যা লিখে গিয়েছেন মল্লিকা।