নামমাত্র মূল্যে কিছু বিক্রি হলে, বলা হয়, জলের দরে মিলছে। তা নিয়ে কখনও সখনও খানিক খেদ জমে থাকে মনে মনে। ধরা যাক, একটা কিছু বেশ শ্রমের উৎপাদন। তা যদি বাজারে জলের দরে বিকিয়ে যায়, তাহলে কি আর স্বস্তি মেলে! তবে এসব বলার দিনও ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। কেননা মিলিয়ে যাচ্ছে জল। জলের দরে আর যে জল মেলে না, এই সহজ সত্যি এখন মর্মে মর্মেই উপলব্ধি করছে মানুষ।
জলের কি আর দর আছে! প্রকৃতির কাছে হাত পাতলেই মিলত অগাধ জল। অতএব নামমাত্র মূল্যে কিছু বিক্রি হলে, বলা হয়, জলের দরে মিলছে। তা নিয়ে কখনও সখনও খানিক খেদ জমে থাকে মনে মনে। ধরা যাক, একটা কিছু বেশ শ্রমের উৎপাদন। তা যদি বাজারে জলের দরে বিকিয়ে যায়, তাহলে কি আর স্বস্তি মেলে! তবে এসব বলার দিনও ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। কেননা মিলিয়ে যাচ্ছে জল। জলের দরে আর যে জল মেলে না, এই সহজ সত্যি এখন মর্মে মর্মেই উপলব্ধি করছে মানুষ। সম্প্রতি তীব্র জল সংকটের মুখোমুখি হয়েছে বেঙ্গালুরু। যদিও এ কোনও একটি রাজ্যের সংকট নয়। জলের সমস্যার দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে গোটা দেশই।
অথচ কৃষি, মাটি ও জলের সখ্যের কথা সভ্যতার পরতে পরতে। মাটির বুকের ভিতর বন্দি যে জল, মাটি পায় না তাকে। মানুষ পায়। পাওয়ার নানা উপায়ও বের করেছে। আবার মাটির বুকে খানিকটা জল ফিরিয়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছে। সাহিত্যিক জয়া মিত্র প্রসঙ্গত ধরিয়ে দিয়েছিলেন, ‘অম্বুবাচী’ শব্দের এক নিবিড় অর্থ। ‘অম্বু’ অর্থে জল, আর ‘বাচি’র সঙ্গে বাক-এর সম্পর্কও স্পষ্ট। অর্থাৎ এ হল জলের সঙ্গে কথোপকথন। যখন কর্ষণ বন্ধ, তখন মাটির সঙ্গে জলের খানিক একান্ত আলাপচারিতা। কৃষিসভ্যতার ভিতরই লুকিয়ে এই জলের দর্শন। মানুষ এই বৃত্তের বাইরের কেউ নয়। তাই মানুষ একদা ভালোবেসেই সেই দর্শন রক্ষা করত। জয়া মিত্র তাঁর একটি বইয়ের নামকরণ করেছিলেন ‘জলের নাম ভালোবাসা’। নামেই স্পষ্ট, জীবন আর ভালোবাসা এখানে সমার্থক হয়ে উঠছে। আর সেই বাঁধন জলের সূত্রেই। ‘পুণ্যতোয়া’ শব্দটিও তো আমরা প্রায়শ ব্যবহার করে থাকি। গঙ্গার জল আমাদের কাছে পবিত্র। তবে, জলের কি আলাদা কোনও ধর্ম আছে! জল তো জল-ই। তাহলে কোন গুণে তা পুণ্যতোয়া হয়ে উঠল। নদীমাতৃক সভ্যতার বিশ্লেষণেই সেই পুণ্যগুণ স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আবার আক্ষেপও করেছিলেন। লিখেছিলেন, “অল্প কিছুকাল হল কালিঘাটে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমাদের পুরোনো আদিগঙ্গাকে দেখলাম। তার মস্ত দুর্গতি হয়েছে। সমুদ্রে আনাগোনার পথ তার চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। যখন এই নদীটির ধারা সজীব ছিল তখন কত বণিক আমাদের ভারত ছাড়িয়ে সিংহল গুজরাট ইত্যাদি দেশে নিজেদের বাণিজ্যের সম্বন্ধ বিস্তার করেছিল। এ যেন মৈত্রীর ধারার মতো মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের বাধাকে দূর করেছিল। তাই এই নদী পুণ্যনদী বলে গণ্য হয়েছিল। তেমনি ভারতের সিন্ধু ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি যত বড়ো বড়ো নদনদী আছে সবগুলি সেকালে পবিত্র বলে গণ্য হয়েছিল। কেন! কেননা এই নদীগুলি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ-স্থাপনের উপায়স্বরূপ ছিল। ছোটো ছোটো নদী তো ঢের আছে—তাদের ধারার তীব্রতা থাকতে পারে; কিন্তু না আছে গভীরতা, না আছে স্থায়িত্ব। তারা তাদের জলধারায় এই বিশ্বমৈত্রীর রূপকে ফুটিয়ে তুলতে পারে নি। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনে তারা সাহায্য করে নি। সেইজন্য তাদের জল মানুষের কাছে তীর্থোদক হল না। যেখান দিয়ে বড়ো বড়ো নদী বয়ে গিয়েছে সেখানে কত বড়ো বড়ো নগর হয়েছে—সে-সব দেশ সভ্যতার কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছে। এই-সব নদী বয়ে মানুষের জ্ঞানের সাধনার সম্পদ নানা জায়গায় গিয়েছে। আমাদের দেশের চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপকেরা যখন জ্ঞান বিতরণ করেন, অধ্যাপকপত্নী তাদের অন্নপানের ব্যবস্থা করে থাকেন; এই গঙ্গাও তেমনি একসময়ে যেমন ভারতের সাধনার ক্ষেত্র ধীরে ধীরে বিস্তারিত করেছিল, তেমনি আর-এক দিক দিয়ে সে তার ক্ষুধাতৃষ্ণা দূর করেছিল। সেইজন্য গঙ্গার প্রতি মানুষের এত শ্রদ্ধা।
“তা হলে আমরা দেখলাম, এই পবিত্রতা কোথায়? না, কল্যাণময় আহ্বানে ও সুযোগে মানুষ বড়ো ক্ষেত্রে এসে মানুষের সঙ্গে মিলেছে—আপনার স্বার্থবুদ্ধির গণ্ডির মধ্যে একা একা বদ্ধ হয়ে থাকে নি। এ ছাড়া নদীর জলের মধ্যে এমন কোনো ধর্ম নেই যাতে করে তা পবিত্র হতে পারে।
“কিন্তু যখনই তার ধারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল, সমুদ্রের সঙ্গে তার অবাধ সম্বন্ধ নষ্ট হল, তখনই তার গভীরতাও কমে গেল। গঙ্গা দেখলাম, কিন্তু চিত্ত খুশি হল না। যদিও এখনো লোকে তাকে শ্রদ্ধা করে, সেটা তাদের অভ্যাসমাত্র। জলে তার আর সেই পুণ্যরূপ নেই।”
এ তো গেল জলের সঙ্গে সভ্যতার নাড়ির যোগের বৃহত্তর দর্শন। তবে, শুধু জলই যে একদিন অপ্রতুল হয়ে উঠবে তা যে মানুষ অনুমান করতে পারেনি, তা নয়। দীর্ঘদিন ধরে যথেচ্ছ হারে ভূগর্ভস্থ জলের অপব্যবহার হয়েছে। এমনকী অপরিকল্পিত নগরায়নের দরুন নদীর গতিপথ পর্যন্ত বদলে গিয়েছে। প্রকৃতি সর্বংসহা ধরে নিয়ে মানুষের অত্যাচার হয়ে উঠেছে মাত্রাছাড়া। প্রকৃতি সহ্য করতে পারে ঠিকই। তবে তার প্রতিরোধ যখন নেমে আসে তখন মানুষের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে। ক্রমশ বাড়তে থাকা জল-সংকট সেই প্রশ্নচিহ্নটিকেই দীর্ঘ করে তুলছে। জনসংখ্যা বাড়ছে, তা নিয়ে আহ্লাদেরও শেষ নেই। ফলত স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ছে জলের চাহিদা। এদিকে মাথার উপর খাঁড়া ঝুলিয়ে রেখেছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। এই পরিস্থিতিতে জলের চাহিদা আর প্রাপ্তির মধ্যে যে দূরত্ব, তা ক্রমশ বাড়ছে। সংকট ক্রমে আসিতেছে। তবে যতক্ষণ না দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে ততক্ষণ তো টনক নড়ে না। তবে সেদিন যে আর দূরে নেই তা সাদা চোখেই স্পষ্ট। বহু শহরেই এখন মানুষকে জল কিনে খেতে হয়। জীবনধারণের সেই ন্যূনতম খরচ কিন্তু কম কিছু নয়। সংকট যত বাড়বে, এ-খরচও বাড়বে। জল নিয়ে ব্যবসারও বাড়বাড়ন্ত। তবু ভারতবর্ষে ভোট এলে কে আর কবে জল নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে! পুকুর চুরি তো এখন অন্য অর্থ ছাড়িয়ে আক্ষরিক হয়ে উঠেছে। জলাশয় বুজিয়ে নগরের শ্রীবৃদ্ধিও ক্রমে চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছে। ফলত যা হওয়ার তাই-ই হচ্ছে। সভ্যতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকে এগোচ্ছে বটে, তবে জল নিয়ে যে ভাবতে হবে স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তায় এ কথা যেন বুঝেও বুঝে উঠতে পারছে না।
সত্যি বলতে, দেখেও না দেখার ভানে বহুদিন যে পেরিয়ে গিয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সংকটের মার নামছে চাবুক হয়ে। প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত- দুই ক্ষেত্রে সার্বিক সচেতনতা না থাকলে, অচিরেই এক ফোঁটা জলের জন্য হাহাকার নেমে আসবে।
আমরা এখন শুধু প্রার্থনা করতে পারি, অবাক জলপান যেন অচিরেই সত্যি না হয়ে ওঠে।