ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। ১৬০ বছর পেরিয়েছেন তিনি। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয়েছেন বারবার, কিন্তু হার মানেননি। জন্মদিনে শুনে নেওয়া যাক তাঁর পথচলার কাহিনি।
একটা চলতি লব্জ আছে যে, আর্টস হল মেয়েদের সাবজেক্ট। কেন? না, আর্টস পড়তে নাকি মেধা লাগে না। প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, মেয়েরা আসলে মেধাবী নয়। এই ২০২১ সালেও কিন্তু এই কথাটা মাঝে মাঝেই শোনা যায়। তাহলে ভাবুন, আরও শ’খানেক কি শ’দেড়েক বছর আগে অবস্থাটা কেমন ছিল! মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রটাই তখনও গড়ে ওঠেনি সেভাবে। সেই সময়ে একটি মেয়ে ভাবলেন, তিনি ডাক্তারি পড়বেন। দুঃসাহসের বহরটা দেখুন একবার! না না, আপনি একা নন, সে সময়ের কলকাতাও তাই-ই ভেবেছিল। তাহলে পুরো গল্পটাই বলি। ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা ডাক্তারের গল্প।
এতক্ষণে বুঝতেই পেরেছেন কার কথা হচ্ছে। হ্যাঁ, তিনি কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। দুটি বাংলা ধারাবাহিকের দৌলতে আজ তাঁর নাম অনেকটা পরিচিত। কিন্তু এই খ্যাতির পিছনে যে দীর্ঘ লড়াই ছিল, সেই লড়াইটা অতটা পরিচিত নয় হয়তো। সে কথাই শোনা যাক।
রবীন্দ্রনাথ যে বছরে জন্মেছিলেন, সেই ১৮৬১ সালেই কাদম্বিনীর জন্ম। ভাগলপুরে। তাঁর বাবা ব্রজকিশোর বসু ভারতের প্রথম মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। ফলে তখনকার আরও অনেক মেয়ের মতো বাড়ি থেকে পড়াশোনায় বাধা পাননি কাদম্বিনী। তিনিই বেথুন স্কুলের প্রথম ছাত্রী, যিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। পাশ করার পরে জুটল খোদ লর্ড লিটনের প্রশংসা ও পুরস্কার। কিন্তু এবার কোথায় পড়বেন তিনি? মেয়েদের জন্য কোনও কলেজই তো গড়ে ওঠেনি তখনও। সুতরাং, তাঁর জন্যই, বেথুন স্কুলকে কলেজে পরিণত করা হল। একজন ছাত্রী, একজন অধ্যাপক নিয়ে কলেজ। বিএ পরীক্ষায় বসলেন কাদম্বিনী। ভারতের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে তিনি একজন। সেবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দু’জনের ডিগ্রি নেওয়া দেখতে এত ভিড় হয়েছিল যে, পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। ভিড় নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল ট্রামলাইন পর্যন্ত!
আরও শুনুন: R K Laxman: কীভাবে জন্ম হয়েছিল Common Man-এর?
এদিকে বিএ পাশের আগেই, মেডিকেল কলেজে ভরতি হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন কাদম্বিনী। অনুমতি মেলেনি। হাল ছাড়েননি। বিএ পাশ করার পরে আবার আবেদন করলেন। আবার নাকচ হল। সম্পূর্ণ অকারণে। এবার আইনি নোটিস পাঠালেন। এবং, অবশেষে তাঁকে ভরতি নিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ।
মেয়েরা পড়বে ডাক্তারি! ছিছিক্কার পড়ে গেল কলকাতায়! তার কদিন আগেই বিয়ে করেছেন কাদম্বিনী, তাও নিজের শিক্ষককে। সে নিয়েও একপ্রস্থ নিন্দা রটেছে। কিন্তু সত্যি বলতে, ভাগ্যিস ‘অবলাবান্ধব’ নামে পরিচিত দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে বিয়ে করেছিলেন তিনি। আজীবন স্ত্রীর উন্নতির জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, যে কোনও বিপদে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন।
দাঁতে দাঁত চেপে পড়তে লাগলেন কাদম্বিনী। সংসার, সন্তান, যা-ই থাক, একটি ক্লাসও মিস হত না তাঁর। বিপত্তি অবশ্য পিছু ছাড়ছিল না। পর পর তিন বছর যে মেডিসিনে ফার্স্ট ক্লাস নম্বর পেয়েছিলেন কাদম্বিনী, এমবি-র ফাইনাল পরীক্ষায় সেই পেপারেই ফেল করানো হল তাঁকে। কোন অধ্যাপক ডাক্তার ইচ্ছাকৃত ভাবে এই কাজ করলেন জানেন? দুঃখের কথা হল, তিনিও একজন বাঙালি। নাম রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র।
কিন্তু কাদম্বিনীকে দমানো কি এতই সহজ? ডাক্তারির ডিগ্রি পাওয়ার জন্য তিনি এবার পাড়ি দিলেন বিলেতে। বিলেত যাওয়ার মতো সংস্থান ছিল না তাঁদের। শিকাগো মহাসম্মেলনের প্রদর্শনীতে ভারতীয় মহিলাদের শিল্পকর্ম পৌঁছে দেওয়ার কাজ নিয়ে তিনি রাহাখরচটুকু জোগাড় করে ফেললেন। দেশে ফিরলেন স্কটিশ কলেজ থেকে ট্রাইপস, এডিনবরা থেকে এফআরসিপি, গ্লাসগো থেকে এমআরসিএস এবং ডাবলিন থেকে ডিএফপি ডিগ্রি নিয়ে! স্বয়ং ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— ভারতের মতো গোঁড়া দেশের একটি মেয়ে বিয়ের পর ডাক্তারি পড়ছে এবং একটি বা দু’টি সন্তানের জন্মের সময়েও মাত্র তেরো দিন কলেজ কামাই করেছে।
দেশে ফিরে শুরু করলেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস। তিনিই প্রথম মহিলা চিকিৎসক, যিনি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্র্যাকটিস করতেন। এমনই খ্যাতি ছড়িয়েছিল তাঁর, যে, কল এসেছিল নেপালের রাজবাড়ি থেকে। মরণাপন্ন রাজমাতাকে সারিয়ে তোলেন তিনি। ভিজিটের টাকা ছাড়াও উপহার হিসেবে এসেছিল ভালো ভালো পোশাক, মৃগনাভি, পিতল-তামা-হাতির দাঁতের তৈরি সুন্দর সুন্দর জিনিস আর একটি সাদা টাট্টু ঘোড়া। আধুনিক ফ্যাশনের পোশাক পরা হোক, বা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে রোগী দেখতে যাওয়া, সেকালের আধুনিক মেয়েদের থেকে কোথাও পিছিয়ে ছিলেন না কাদম্বিনী। মৃত্যুর দিনেও তাঁর অর্জিত ভিজিটের পরিমাণ ছিল পঞ্চাশ টাকা, যে টাকায় নাকি সেকালের কলকাতায় শ-পাঁচেক লোককে একদিন খাওয়ানো যেত!