নগ্নতা নিয়ে সমাজে ট্যাবুর অভাব নেই। কিন্তু পুরুষের নগ্নতা যেন অস্বস্তির চেয়েও বেশি হাসির উদ্রেক করছে। পুরুষের নগ্নতা নিয়ে গড় ধারণা কি এমনটাই? প্রশ্ন জাগিয়ে দিল অস্কারের মঞ্চ।
আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মঞ্চ মানেই স্টাইল আর এটিকেটের কড়াকড়ি। কে কেমন সাজবেন, কোন ডিজাইনারের পোশাক পরবেন, তা নিয়ে মাথাব্যথার শেষ থাকে না তারকাদের। পোশাকের ভালো খারাপ নিয়ে ঝড় বইয়ে দেন সাংবাদিক-সমালোচকেরাও। সেখানেই কিনা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে প্রবেশ করলেন এক পুরুষ। যা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন দর্শকাসনে বসে থাকা অভিনেত্রীরা। অস্কারের মঞ্চে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাই প্রশ্ন জাগিয়ে দিল, পুরুষের নগ্নতা কি আদতেই হাসির খোরাক?
আরও শুনুন:
নগ্নতাই যখন পেশা, কেমন কাটে ন্যুড মডেলদের দিন?
পুরুষের নগ্নতাকে আগেও দেখেছে অস্কারের মঞ্চ। ১৯৭৪ সালের ৪৬তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে ডেভিড নিভেন যখন এলিজাবেথ টেলরকে পরিচয় করাচ্ছেন, সেই সময়েই এক নগ্ন ব্যক্তি মঞ্চের উপর দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এই বিশেষ আচরণকে বলা হত স্ট্রিকিং, যা সাতের দশকে ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই প্রসঙ্গ টেনেই এবার সঞ্চালক জন কিমেল মজার ছলে দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলেন, “আজকে এই স্টেজ দিয়ে একজন নগ্ন পুরুষ দৌড়ে যাবেন এমনটা কি ভাবতে পারেন?” এরপরেই আকস্মিকভাবেই নগ্ন হয়ে মঞ্চে আসেন মার্কিন কুস্তিগির, অভিনেতা ও র্যাপার জন সিনা। তাঁর নগ্ন হয়ে হেঁটে আসার সময়েই অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন অস্ট্রেলিয়ার অভিনেত্রী মার্গট রাবি।
আরও শুনুন:
পুরুষের নগ্নতায় বহু বিতর্ক, তবু পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি কি আদৌ বদলায়?
দেখা যাচ্ছে, পুরো বিষয়টি ঘটেছে মজার ছলেই। আর এখানেই প্রশ্ন, পুরুষের নগ্নতাকে তাহলে কেবল তামাশা হিসেবেই দেখা হচ্ছে? নারীর নগ্নতার ক্ষেত্রে মেল গেজের দাবি তো কারও অজানা নয়। আবার কোনও নারী তাঁর শরীরকে স্বেচ্ছায় মেলে ধরতে চাইলে, ‘মাই বডি মাই চয়েস’-এর স্লোগান তুললে তা সমাজের রক্তচক্ষুর মুখে পড়ে। সেই শৃঙ্খল ভেঙে নগ্নতাকে বহুবার বেছে নিয়েছেন অভিনেত্রীরা। এমনকি বিনোদনের দুনিয়াতেও, কানের রেড কার্পেটে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নগ্ন শরীর। যা সবসময়েই এই সমাজকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। সেখানে পুরুষের নগ্নতা যতখানি অস্বস্তির উদ্রেক করছে, তার চেয়ে বেশি হাসির খোরাক হয়েই দাঁড়াচ্ছে। এমনকি একে ‘রুচিহীন ঠাট্টা’ বলছেন খোদ অভিনেতা জন সিনাও। তিনিই সাফ জানাচ্ছেন, ‘মেল বডি ইজ নট আ জোক’, অর্থাৎ পুরুষের শরীরকে এইভাবে তামাশার কেন্দ্র করে তোলায় তাঁর আপত্তি। নিন্দা নয়, অস্বস্তিও নয়, তামাশার প্রবণতাটি কি আসলে নেপথ্যের সেই ক্ষমতার বয়ানকে চিনিয়ে দিচ্ছে, যে ভাষায় কথা বলে পিতৃতন্ত্র? এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যৌনতা নিয়ে সমাজে আজও যেভাবে কাজ করে চলে নানারকমের ট্যাবু বা রক্ষণশীলতা, তার সঙ্গে কিন্তু পরতে পরতে মিশে রয়েছে ক্ষমতার বিন্যাস। পুরুষশাসিত সমাজের রাঙা চোখ বরাবরই মেয়েদের বেঁধে রাখতে চেয়েছে নানা ধরনের বিধিনিষেধে। নারীশরীরে লক্ষ্মণরেখা টেনে রাখাও তার চেয়ে আলাদা নয় কোনও অংশেই। কিন্তু যে মেল গেজ নারীকে পণ্যের চোখে দেখতে অভ্যস্ত, পুরুষের শরীর সেই জায়গায় এসে দাঁড়ালে তার ক্ষমতাতন্ত্রই আহত হয় কোথাও। এর আগে রণবীর সিং, মিলিন্দ সোমানদের নগ্নতা নিয়েও বিতর্কের ঝড় হয়তো সেই আঘাতকেই চিনিয়ে দেয়। গবেষকেরা বলেন, যেখানে অসংগতি, অর্থাৎ স্বাভাবিক বলে চেনা যা-কিছুর বাইরে অন্যরকম কিছু ঘটছে, তাই হাসির খোরাক জোগায়। পুরুষতন্ত্র কামনার উপাদান হিসেবে নারীর নগ্নতাকেই দেখতে অভ্যস্ত, সেই একই স্পটলাইটের নিচে পুরুষের নগ্নতা এসে দাঁড়ালে তার চেনা ছকটি ঘেঁটে যায়। আর সেই গুলিয়ে যাওয়ার মোকাবিলা করতেই হয়তো অস্ত্র হয়ে ওঠে হাসি।