অন্যান্য ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের মতো বই-বাণিজ্যের জগৎটিতেও তাই পুরুষপ্রাধান্যই ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার শরিক হয়েছেন নারীরাও। নারীদিবসের আবহে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র সঙ্গে কথোপকথনে তেমনই কয়েকজন প্রকাশক, যাঁরা পরিচয়ে নারী। কথা বললেন সুমিতা সামন্ত, সোমাইয়া আখতার, ঐত্রেয়ী সরকার এবং মাধবী মজুমদার। শুনলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
সহায়তা: চৈতালী বক্সী, অঙ্কুর নন্দী
ঘরের আগল ঠেলে কাজের দুনিয়ায় পা রাখার পথটি মেয়েদের জন্য সহজ ছিল না। সেখানে নিজের হাতে ব্যবসা গড়ে তোলার ভাবনা তো আরোই দূরের। সমাজে যে পিতৃতন্ত্রের আদলটি এখনও নারীর বুদ্ধি, মতামত, চিন্তা, এই সবকিছু নিয়েই দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, সেখানে নারীকে ‘কর্তা’ হিসেবে মেনে নেওয়া কি সহজ! অন্যান্য ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের মতো বই-বাণিজ্যের জগৎটিতেও তাই পুরুষপ্রাধান্যই ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার শরিক হয়েছেন নারীরাও। নারীদিবসের আবহে তেমনই কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে কথোপকথনে সংবাদ প্রতিদিন শোনো, যাঁরা পরিচয়ে নারী।
‘লা স্ত্রাদা’-র কর্ণধার সুমিতা সামন্ত অবশ্য নিজেকে প্রকাশক বলতে চান না। তিনি শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সমগ্র কাজটিকে দেখে চলেন এখনও। তাঁর মতে প্রকাশনার কাজের প্রথম চ্যালেঞ্জ, যা নিয়ে কম কথা হয়, বিষয় হিসেবে সেগুলোই বেছে নেওয়া। সুমিতা যেহেতু এই ধরনের প্রান্তিক বিষয়ই বাছেন, আর নারীও তো আসলে এখনও একরকমভাবে প্রান্তিক, ফলে আপনিই তাদের কথাও বিষয় হিসেবে চলে আসে। নারীর অপরত্বকে বুঝে নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিও ছাপ ফেলে যায় সে কাজে।
‘রাবণ’-এর প্রকাশক সোমাইয়া আখতার স্পষ্টই বলছেন, নারী বলে তো বটেই, পাশাপাশি ধর্মগত অপরত্ব এবং গ্রাম থেকে শহরে আসার কারণেও একধরনের অপরত্বের মুখোমুখি পড়তে হয়েছে তাঁকে। গ্রাম থেকে শহরে পৌঁছনোর পথে তিনি যাঁদের হাত ছাড়িয়ে এলেন, তাঁদের কথন থেকে ইতিহাস বুনে চলেছেন ছাপার অক্ষরে। অন্দরের ইতিহাস লিখতে গেলে নারীদের থেকে যেভাবে উপাদান পাওয়া যায়, পুরুষের থেকে সেভাবে পাওয়া সম্ভব নয় বলেই তাঁর মত।
‘ঋত প্রকাশন’-এর কর্ণধার ঐত্রেয়ী সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি ছেড়ে এই পেশায় এসেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অবশ্য সমস্যার চেয়ে সহমর্মিতার পাল্লা ভারী। কাজের সুযোগ পাওয়া বা অন্যান্য ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের সম্মুখীন হওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাঁর হয়নি। তবে তিনি মনে করেন, আসলে ক্ষমতা একরকমভাবে আধিপত্য জারি রাখে। মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন জায়গা পর্যন্ত যেতে কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। এ কথা শুধু প্রকাশনার ক্ষেত্রে নয়, সব পেশার জন্যই প্রযোজ্য। আর সেই গণ্ডিটা পেরোতে চেষ্টা করলেই, সেখানে বাধা আসবেই।
‘বৈভাষিক’-এর মাধবী মজুমদার এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন বিবাহসূত্রে। কিন্তু প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব সামলাতে সমস্যা নেই তাঁর। বই নির্বাচনের ভাবনায় নারী পরিচয়টি কখনও সামনে আসে হয়তো, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে ভাবেন জরুরি বই প্রকাশের কথা।
আসলে দিন বদলেছে, বদলেছে ভাবনাও। কাজ এখন আর কেবল ‘মেয়েলি’ বা ‘পুরুষালি’ গণ্ডিতে সীমায়িত থাকছে না। আর নিজে হাতেই দায়িত্ব নিয়ে সেই লক্ষ্মণরেখা মুছে দিয়ে চলেছেন নারীরা।