জীবিত থেকেই যাঁরা অঙ্গদান করেন, সেই তালিকায় এগিয়ে মেয়েরাই। গ্রহীতার ভূমিকায় অবশ্য পুরুষের হারই বেশি, নারী গ্রহীতার হার নেহাতই নগণ্য। মেয়েদের জন্য যে দাত্রীর ভূমিকাই সমাজ নির্দিষ্ট করে রেখেছে, সে কথাই কি আরও একবার স্পষ্ট করে দেয় এই হিসেব?
সমাজে হোক কি পরিবারে, নারীর ভূমিকাটি অনেকখানিই স্থির হয়ে আছে দাত্রী হিসেবে। নারী মাত্রেই তিনি তাঁর চাহিদাকে পিছনে রেখে অন্যদের চাওয়া পাওয়ার কথা আগে ভাববেন, এমনই এক অলিখিত নিয়ম যেন রয়েই গিয়েছে। রান্না করার কাজটি সাধারণত বাড়ির মহিলাদের জন্যই বরাদ্দ, অথচ তিনি কী খান, সে কথা আমরা কজনই বা খেয়াল করে দেখি? খাবারের সেরা অংশ একসময় বরাদ্দ থাকত বাড়ির পুরুষদের জন্যই। এখনও আগে সন্তান, স্বামী, কিংবা বাড়ির বড়দের জন্য খাবার বেড়ে দেওয়ায় যে যত্ন থাকে, সেখানে গৌণ হয়ে যায় নিজের কথাই। এই যে পরিচর্যার ভারটি মেয়েদের জন্যই একরকম করে নির্দিষ্ট হয়ে আছে, দেখা যাচ্ছে, অত্যন্ত বাস্তব ক্ষেত্রেও তার বিশেষ বদল নেই। পরিবারের কোনও পুরুষ যদি গুরুতর অসুস্থ হন, যদি সেক্ষেত্রে অঙ্গদানের প্রয়োজন হয়, সেখানে অধিকাংশ সময়েই এগিয়ে আসেন স্ত্রী, কন্যা বা মা। দান করার মত সুস্থ স্বামী, পুত্র বা বাবা থাকলেও তাঁরা দান করেন কম, সমীক্ষা কিন্তু এমন কথাই বলছে। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, জীবিত অবস্থায় অঙ্গদানকারীদের মধ্যে নারীর হারই বেশি। কিন্তু উলটোদিকেও ছবিটা ততটাই হতাশার। অর্থাৎ যেখানে মেয়েদের অঙ্গের প্রয়োজন? গ্রহীতার তালিকায় মেয়েদের হার কিন্তু পুরুষের চেয়ে অনেক কম। তাঁদের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পুরুষের তুলনায় অনেক কম, এমন কথা যখন বলা যাচ্ছে না, তখন মেনে নিতেই হয় যে, আসলে প্রতিস্থাপনের সুযোগটাই তাঁদের ক্ষেত্রে কম মেলে।
আরও শুনুন:
মজুরি কাটার ভয়! ঋতুস্রাব এড়াতে জরায়ুও কেটে বাদ দিয়েছেন মহিলারা
ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশনের এক সমীক্ষা স্পষ্টই দেখাচ্ছে, এই তালিকায় লিঙ্গবৈষম্যের ছবিটি স্পষ্ট। কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যদি একজন মহিলা কিডনি পান, একই সময়ে অন্তত ৫ জন পুরুষ কিডনি পাচ্ছেন। গুজরাটের এইচ এল ত্রিবেদী ইনস্টিটিউট অফ ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন সার্ভিসেস নামে এক বড় হাসপাতালে গত দুই দশকের অঙ্গদানের সমীক্ষা করে গবেষকরা বলছেন, ২০০০-২০২০ পর্যন্ত যত কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে, তার মধ্যে জীবিত দাতাদের ৭৯% মহিলা। জীবিত দাতাদের মধ্যে ৩৩.৭% গ্রহীতার মা, ২০% স্ত্রী। কন্যাদের সংখ্যা খানিকটা কম, বোনেদের সংখ্যা সব থেকে বেশি। আবার বোন যদি বিবাহিত হন তবে তাঁর স্বামী, শ্বশুরবাড়ির পরিবারের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অবিবাহিতা মেয়েরা সাধারণত অঙ্গদান করেন না, কারণ এর সঙ্গে পরবর্তীকালে বিয়ে না হওয়ার সম্ভাবনা জড়িয়ে থাকে। শুধু একটি সমীক্ষা নয়, এদেশে যতগুলি সমীক্ষা হয়েছে সবেতেই লিঙ্গবৈষম্যের এই চিত্রই পাওয়া গেছে। যদিও কেবল এ দেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই ছবিটা কমবেশি একরকম, বলছেন গবেষকেরা।
আরও শুনুন:
বাবার পদবি ব্যবহার করতে লাগবে স্বামীর অনুমতি! এ দেশের মেয়েদের বড় হতে নেই?
আসলে পরিবারের প্রতিপালনের দায় মূলত পুরুষের, এমন কথাই এখনও চলতি বিশ্বাসে ধরে নেওয়া হয়। তাই তাঁর সুস্থ থাকা জরুরি। নারীর ভূমিকা তেমন অপরিহার্য বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে না বলেই তাঁকে অঙ্গদানের ঘটনা ঘটছে কম। অন্যদিকে নারীর ভূমিকা ঘর সামলানোর, পরিবারের পরিচর্যা করার। সেই সেবার জায়গা থেকে তিনিই যে অসুস্থ পুরুষকে সারিয়ে তুলবেন, এমনটাও প্রায় স্বতঃসিদ্ধই, তাই তা নিয়ে কেউ আলাদা করে কথাও বলে না। সব মিলিয়ে, এখানেও সেই বৈষম্যের ছবিটিই বড় স্পষ্ট হয়ে থাকছে। এত আধুনিকতা আর নারীমুক্তির স্লোগানের পরেও, সেই ছবিতে বদল এল কই!