অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে নির্দোষ বলেই গণ্য করতে হবে, এ কথা জানায় খোদ ভারতীয় আইনই। কিন্তু সম্প্রতি রাজস্থানে তিন মুসলিম শিক্ষককে বরখাস্ত করার ঘটনায় দেখা গেল, সে কথাও মানা হল না আদৌ। বরং অভিযোগ ওঠা মাত্রই তড়িঘড়ি শাস্তি ঘোষণা করতে তৎপর হয়েছে সরকার। দেশের ধর্মীয়-রাজনৈতিক ছবি বদলাচ্ছে এ কথা স্পষ্ট, কিন্তু তার জেরে কি এবার সাংবিধানিক ক্ষেত্রেও ধর্মপরিচয়ই হয়ে দাঁড়াবে মুখ্য?
সাম্প্রতিক কালে কখনও লাভ জিহাদের ধুয়ো, কখনও ধর্মান্তরণ, এমন নানা অভিযোগের আঁচে তেতে উঠেছে দেশ। বারে বারেই সে অভিযোগের নিশানা গিয়েছে মুসলিমদের দিকে। বলা হয়েছে, আসলে নানাভাবে হিন্দুদের দমন করতে চাওয়াই মুসলিমদের লক্ষ্য। আর সেই ধারণা থেকেই ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে বিদ্বেষের বীজও। এইসব অভিযোগে শোরগোল তুলে আসলে একভাবে মুসলিমদের ক্রমশ একঘরে, কোণঠাসা করে দিতে চাইছে হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ, এমনটাই মত অনেকের। ফলে এসব কথা নতুন নয়। তবে সম্প্রতি রাজস্থানের এক সরকারি স্কুলে যেভাবে তিন মুসলিম শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাতে ফের উসকে উঠেছে সেই একই চর্চা। কারণ এখানেও অভিযোগের সুর সেই একই। ধর্মান্তরণের অভিযোগ তুলে ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন খোদ সে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। তার চেয়েও বড় কথা, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করা, তদন্ত শুরু করা, কিংবা সেই অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার যে পদ্ধতি, তার কোনও কিছুই এক্ষেত্রে সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। বরং অভিযোগ ওঠা মাত্রই প্রায় রাতারাতি সাসপেন্ড করা হয়েছে তিন শিক্ষককে। আর সেই ঘটনায় আইনের সমদর্শিতাই একভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। কারণ, ভারতীয় আইনই প্রত্যেক অভিযুক্ত, এমনকি অপরাধীর জন্যও নির্দিষ্ট অধিকার বরাদ্দ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তির দিকে অভিযোগের তির ওঠেও, সেই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে কোনোভাবেই দোষী বলে চিহ্নিত করা যায় না। অথচ এই ক্ষেত্রে যেভাবে তিন শিক্ষককে বরখাস্তের নির্দেশ শোনানো হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে, তাঁদের অপরাধী বলে ধরে নেওয়াই হয়েছে প্রাথমিকভাবে। আর সেই পূর্বনির্ধারিত ধারণাই বাকি পদ্ধতিকে প্রভাবিত করছে, এমনটা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও শুনুন:
বাড়ছে মুসলিম বিদ্বেষ, অভিযোগের হার বেশি বিজেপিশাসিত রাজ্যেই, বলছে সমীক্ষা
চলতি মাসেই ‘সর্ব হিন্দু সমাজ’ নামে একটি হিন্দুত্ববাদী শিবিরের তরফে ওই শিক্ষকদের নামে অভিযোগ করা হয়েছিল, তাঁরা হিন্দু পড়ুয়াদের নমাজ পড়তে বাধ্য করছেন। যদিও একটি বিজেপিশাসিত রাজ্যে কোনও সরকারি কর্মী এহেন কাজ করবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকেই। পাশাপাশি এক পড়ুয়ার ট্রান্সফার সার্টিফিকেটে তার ধর্ম ‘হিন্দু’-র বদলে ‘মুসলিম’ লেখা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে। আর এই সমস্ত বিষয়টিকেই ধর্মান্তরণের ষড়যন্ত্র বলে সরব শিক্ষামন্ত্রী মদন দিলাওয়ার। অভিযোগ উঠতেই দুই শিক্ষক ফিরোজ খান ও মির্জা মুজাহিদকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেন তিনি। শাবানা নামে আরেক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়, দুদিন পরেই বরখাস্ত করা হয় তাঁকেও। একটি ভিডিও বার্তায় শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেন, সব অভিযোগই সত্যি। নিজের বক্তব্যে তিনি সাফ জানিয়েছেন, এই অভিযোগ শোনা মাত্রই কড়া ব্যবস্থা নিতে তিনি বদ্ধপরিকর হন। আর ঘটনাক্রম স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, কোনোরকম তদন্ত শুরুর আগেই সেই পদক্ষেপ করেছেন তিনি। আর এই ঘটনাকে মেরুকরণের চেষ্টা বলেই অভিযোগে সরব সে রাজ্যের মুসলিম ফোরাম।
আরও শুনুন:
উদ্ধার করেন সুড়ঙ্গে আটক শ্রমিকদের, ‘এই তো পুরস্কার!’ সরকার বাড়ি ভাঙায় বললেন ব্যক্তি
ধর্মান্তরণের অভিযোগে মুসলিমদের দিকে আঙুল তোলা হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে নতুন নয়। কিন্তু অভিযোগ আদৌ সত্যি কি না, তা প্রমাণিত হওয়ার একটি নির্দিষ্ট আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াও রয়েছে। কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে দোষী বলে দেগে দিলে দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরটিই সংকুচিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মপরিচয় দেখেই যদি সন্দেহ জোরালো হয়, তবে তা দেশবাসীদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যের পরিসরকেই নষ্ট করতে থাকে। সে আশঙ্কাকেই একরকম ভাবে মনে করিয়ে দিল এই সাম্প্রতিক ঘটনা।