রাম মন্দিরকে ঘিরে যে আন্দোলন তার রাজনৈতিক অভিমুখ থাকতে পারে। তবে, ক্রমশ তা যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা জনতার আবেগের বহিঃপ্রকাশ। তা কোনও নির্দিষ্ট মতালম্বীদের আন্দোলন আর ছিল না। আর তাই বিন্দু বিন্দু দানে সিন্ধু হয়েছে অযোধ্যাপুরী। সেতুবন্ধনের কাঠবিড়ালির ভূমিকা নেওয়ার মতোই এই যে অসংখ্য মানুষ রাম মন্দিরের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, এর গুরুত্ব কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
মাত্র ১১ টাকা! এতবড় রাম মন্দির। বিপুল এই আয়োজন। তাতে ওই সামান্য অর্থে কী আর হতে পারে! তবু সেটুকুই প্রতিবেশীর থেকে ধার করেছিলেন একজন আদিবাসী মহিলা। রামের মন্দির হচ্ছে দেশে, আর সেখানে তাঁর অবদান থাকবে না! ধার করা অর্থই তিনি তাই তুলে দিয়েছিলেন রাম মন্দিরের উদ্দেশে। হতে পারে তা অঙ্কে সামান্য, তবু গুরুত্বে তা অসামান্য-ই।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: শস্যের রূপকে রাম-সীতা ভাই-বোন, রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ মানুষের যন্ত্রণার কাব্য
এ শুধু একটি মাত্র ঘটনা। এমন অসংখ্য ঘটানার সমাহার রাম মন্দিরকে কেন্দ্র করে। যেন ঠিক সেই কাঠবিড়ালির গল্প। অতবড় সেতু নির্মাণে যার ভূমিকা ছিল কণামাত্র বালি দানের। তবু, বড় কোনও কাজে এরকম ছোট ছোট ভূমিকাও তো ফেলে দেওয়ার নয়। তাই ইতিহাস লিখে রাখুক বা না-ই রাখুক, সেই সব ছোট ছোট স্মৃতি সময়ের সিন্দুকে ঠিকই তোলা থাকে।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: কৃত্তিবাসের হাত ধরে যেভাবে ‘বাঙালি’ হলেন বাল্মীকির রাম
উদ্বোধনের দিন ঘোষণা থেকেই রাম মন্দিরকে ঘিরে পাক খেয়ে চলেছে রাজনীতি। সে সব হয়তো অস্বীকার করা যায় না। তার নিশ্চিত ভিত্তি আছে, যুক্তি আছে, পালটা যুক্তিও আছে। তবে সব পেরিয়ে যা বাস্তব তা হল রামের মন্দির। সেই রামের মন্দির, যাঁকে মহাকাব্যের কবি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আদর্শের চূড়ান্ত প্রতিমা হিসাবে। প্রতিমা তবে নিষ্প্রাণ নন। রাম জীবন্ত, আর তাই তাঁর মধ্যে গুণাবলির এমন অপূর্ব সমাবেশ। নানা দিক থেকেই জীবনের আদর্শের যে মাপকাঠি, তার সবথেকে কাছাকাছি পৌঁছনোর আকাঙ্ক্ষার যদি কোনও নাম হয়, তবে তিনিই রাম। সে পিতৃসত্য পালন হোক, কিংবা আদর্শ রাজ্য গঠন, রাম যেন প্রতিষ্ঠা করেছেন- সবার উপরে আদর্শ সত্য। মহাকবির তাই-ই ছিল অভিপ্রায়। তার মানে এই নয় যে, রাম তাঁর কাজের জন্য সমালোচিত হনিনি, প্রশ্নের মুখে পড়েননি। তবে, সেই সব প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্নের ভিতর দিয়েই তো ফুটে উঠেছে মহাকাব্যিক জীবন। যে জীবন নানা অভিঘাতে পূর্ণ। আর তাই রামচরিত্র জনতার হৃদয়ে চিরকালীন স্থান লাভ করেছে। স্থান বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে রাম চরিত্রের নানা ধরণ। নানা আঞ্চলিক গুণ এসে লেগেছে তাঁর গায়ে। তবু মৌলিক যে আদর্শবাদী কাঠামো, যে ঐক্য আর সমন্বয়ের সাধনা রামের বিশিষ্টতা, তা কখনই মলিন হয়নি। সেই রামের মন্দির নির্মাণ তো আসলে জনতারই মন্দির। আর তাই সেখানে থেকে গিয়েছে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের প্রকাশ।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: কৃত্তিবাস থেকে সুকুমার, বহু ধারায় খরস্রোতা বাংলায় রামায়ণ চর্চা
ভাবলে অবাক হতে হয়, আজকের ভারতবর্ষে যাঁদের আয় যৎসামান্য, তাঁরাও মুক্তহস্তে রামের মন্দিরের জন্য অর্থদান করেছেন। এগিয়ে এসেছিলেন ঘাটকুপারের যৌনকর্মীরা। যে যা পেরেছেন, তা তুলে দিয়েছেন রামের জন্য। সারা দিন চেয়েচিন্তে যা উপার্জন হয়, সে অর্থও তুলে দিয়েছেন ভিক্ষুকরা। আবার পেনশনে দিন চলে, এমন অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরাও তাঁদের সাধ্যমতো অর্থ দান করেছেন। রাম মন্দিরের রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিনে বহু তারকার সমাবেশ। আপাত বিভেদ ভুলে উত্তর-দক্ষিণের সেলেবরা যেন এক হয়েই হাজির হয়েছেন অযোধ্যায়। প্রচারের উজ্জ্বল আলো তাঁদের মুখে। তাঁদের কথা সকলেই জানেন। তবে হয়তো অগোচরেই থেকে যাবে এই সব অজানা মানুষদের সাধ আর সাধ্যের অতীত দানের কথা।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: বাংলার আছে নিজস্ব ‘অযোধ্যা’, এখনও বইছে ক্ষীণস্রোতা ‘সরযূ’
সত্যি বলতে রাম মন্দিরকে ঘিরে যে আন্দোলন তার রাজনৈতিক অভিমুখ থাকতে পারে। তবে, ক্রমশ তা যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা জনতার আবেগের বহিঃপ্রকাশ। তা কোনও নির্দিষ্ট মতালম্বীদের আন্দোলন আর ছিল না। আর তাই বিন্দু বিন্দু দানে সিন্ধু হয়েছে অযোধ্যাপুরী। সেতুবন্ধনের কাঠবিড়ালির ভূমিকা নেওয়ার মতোই এই যে অসংখ্য মানুষ রাম মন্দিরের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, এর গুরুত্ব কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
নাহ্ তাঁরা কোনও রাজনীতির রামের জন্য তাঁদের দান তুলে রাখেননি, তাঁদের আবেগের সবটুকু প্রকাশ হৃদয়ের মন্দিরে তুলে রাখা চিরকালীন সেই রামের জন্যই।