আচ্ছা কখনও ভেবে দেখেছেন স্থাননামে কীভাবে এসে পড়ল ডোম? ডোমজুড়, ডোমকল; কেন জনপদের নামে ডোম শব্দের এত আনাগোনা? হালে সরকারি খাতা থেকে ‘ডোম’ শব্দটি মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে তাঁদের বলা হবে ‘সৎকারকর্মী’। কিন্তু এই ডোম শব্দটা এল কোথা থেকে? ছেলেভুলানোর ছড়ার প্রসঙ্গে সেই গল্প লিখলেন সৌভিক রায়।
বিজয় গুপ্ত, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, জগজ্জীবন ঘোষালদের মঙ্গলকাব্যে ডোমদের উল্লেখ রয়েছে। তবে মধ্যেযুগের কবিরা কেউই ডোমদের সম্মানজনক স্থান দেননি। ঘনরাম চক্রবর্তী ধর্মমঙ্গলে ডোমদের প্রতি তাও কিছুটা সদয় হয়েছেন। চর্যাপদ ডোমদের নিয়ে বলছে- “নগর বাহিরি যে ডোম্বী তোহারি কুড়ি আ”। অর্থাৎ নগরের বাইরে কুঁড়েঘর, সেখানেই ডোমদের বসবাস। এটাই কি তাঁদের পরিচয়?
:আরও শুনুন:
কবিতা মাথায় এলে আভেন নিভিয়ে লিখে নেব, বলেছিলেন দেবারতি
হালে সরকারি খাতা থেকে ডোম শব্দটি মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে তাঁদের বলা হবে সৎকারকর্মী। প্রগতিশীল পদক্ষেপ হল বটে কিন্তু ডোম মানে কি কেবলই মৃতদেহ সৎকার করে দিন গুজরান করা মানুষজন? না কি আরও কিছু রয়েছে…এর উত্তর দিতে পারে একটি খেলা, থুড়ি একটি খেলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ছড়া-
আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে।
ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।।
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।
ঢুলি গেল সেই কমলাফুলি।।
কমলাফুলির টিয়েটা।
সুয্যিমামার বিয়েটা।।
এই ছড়ায় লুকিয়ে রয়েছে ডোমদের বীরত্বের অখ্যান। আগডোম মানে অগ্ররক্ষী ডোম সৈন্যদল, বাগডোম অর্থাৎ পার্শ্বরক্ষী সেনা এবং ঘোড়াডোম হল অশ্বারোহী সৈন্যদল। এই ডোম সেনারাই ছিল বাংলার পশ্চিম-সীমান্তের রক্ষক। বিষুপুরের মল্লরাজাদের, রাজনগরের সামন্তরাজাদের ডোমসেনা ছিল। ঝাড়গ্রামের শিলদা অঞ্চলে ডোমদের রাজ্য ছিল। রাজধানী ছিল ডোমগড়। সেনাপ্রধানের মতো রাজকর্মচারীর পদও মিলত ডোমদের। ডোমসেনাদের দায়িত্ব ছিল যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষকে আক্রমণের পথ তৈরি করা, শত্রুর উপর নজরদারি চালানো, যুদ্ধের পরিস্থিতির উপর নজর রাখা।
সাতগাঁ অর্থাৎ সপ্তগ্রামের বাগদি রাজা রূপারাজা ও বর্মনরাজ হরিবর্মার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ডোমসেনারা। বঙ্গদেশে রাজাদের হয়ে ডোমসেনাদের লড়াই করার এমন অনেক নজির রয়েছে। রাঢ় বাংলার এই অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের বীরত্বে ভর করেই রাজা, মহারাজারা ইতিহাসে পরাক্রমী বীর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। কিন্তু বঙ্গের প্রচলিত ইতিহাসে ডোমসেনাদের বীরগাথা ঠাঁই পায়নি।
তবে ব্যতিক্রম রয়েছে। ধর্মমঙ্গলে জায়গা পেয়েছে কালু ডোম, লখাই ডোমদের বীরত্বের কাহিনি। এর কারণ অবশ্য ভিন্ন। ডোমরা আদপে ধর্মঠাকুরের উপাসক। ধর্মঠাকুরের পুরোহিতদের বলা হত পন্ডিত। ধর্মঠাকুরের আদিপুরোহিত হিসেবে পন্ডিত রামাই ডোমের নাম পাওয়া যায়। রাঢ় বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লৌকিক দেবতা হলেন ধর্মঠাকুর। লৌকিক গবেষকদের কেউ কেউ বলেন, ধর্মঠাকুর বৌদ্ধ সংস্কৃতির ফসল। আবার কারও কারও মতে, শিব, ধর্মঠাকুর হিসাবে দক্ষিণ বাংলার লোকায়ত দর্শনে মিশে গিয়েছেন। অনেকেই, ডোমদের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মনে করেন। আবার বিজয় গুপ্ত ডোমস্ত্রীদের চণ্ডী রূপে কল্পনা করেছেন। তাঁর মঙ্গল কাব্যে দেখিয়েছেন,
চণ্ডী শিবের জন্যে খেয়া পারাপারের ঘাটে অপেক্ষা করছে। ডোমনী চণ্ডী হলে, তাঁর পুরুষ শিব। বার বার মনে হয়, বাংলার লৌকিক সংস্কৃতি ধর্মঠাকুর-ডোম-শিব-বুদ্ধ, সক্কলকে মিলিয়ে দিয়েছে।
ধর্মঠাকুরের সঙ্গে ডোমদের এহেন সখ্যই, ধর্মমঙ্গলের তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ আসন পাওয়ার কারণ।