লক্ষ্মণকে প্রেমপ্রস্তাব দিচ্ছেন শূর্পণখা। সেখানে রাম মনে করিয়ে দিচ্ছেন, নারীর এক স্বামীর বিধান দিয়েছে শরিয়ত। হ্যাঁ, এমনই রামকথার খোঁজ মেলে আমাদেরই দেশে। আসলে কোনও একটিমাত্র রামায়ণ নয়, দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে একাধিক রামকথা। এমনকি মুসলিমরাও নানাভাবে দেখেছেন হিন্দুধর্মের মর্যাদা পুরুষোত্তমকে। শুনে নেওয়া যাক সেই অন্য রামের কাহিনি।
সাম্প্রতিক কালে রামের একটি ধারণাই ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। যে ধারণা অন্যরকম মতকে গুরুত্ব দিতে বিশেষ রাজি নয়। অথচ খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, রামকে কেন্দ্র করেই এই একমাত্রিকতার পালটা এক বহুত্বের বয়ানও জারি ছিল এই দেশেই। মুখে মুখে কিংবা লিখিত আকারে ভারতবর্ষে যে কত রামায়ণ ছড়িয়ে রয়েছে, তা দেখলে অবাক লাগে। এমনকি দেশের বাইরেও বহু রূপে, বহুত্বের স্বরূপে ধরা দিয়েছেন রাম। আশ্চর্যের কথা হল, এই নানারকম বয়ানের মধ্যে রয়েছে রামকথার মুসলিম পাঠও। অর্থাৎ, হিন্দু ধর্মে যিনি মর্যাদা পুরুষোত্তম, তাঁকে নিজেদের মতো করে খুঁজেছেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও।
-: আরও শুনুন :-
বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে শতাধিক রামায়ণ, রামকে কেন্দ্র করেই জারি ভিন্নমতের অধিকারও
কেরলের মালাবার অঞ্চলে মূলত মুসলমান গোষ্ঠীর বসবাস, যাদের মোপলা বা মাপ্পিলা জনগোষ্ঠী বলে। মূল রামায়ণের সুরকে এক রেখে তাঁরা নিজেদের মতো করে তৈরি করে নিয়েছেন ‘মাপ্পিলা রামায়ণ’। তাঁদের ‘র’-এর উচ্চারণ শুনতে ‘ল’-এর মতো, তাই এই কাহিনির নায়ক ‘লামা’, খলনায়ক ‘সুলতান লাভন্’। অন্য কোনও দেশে নয়, রামচন্দ্রের জন্মভূমি ভারতবর্ষেই গড়ে ওঠা এই রামকথায় শূর্পণখা হলেন ‘বিবি শূর্পণখা’, তাঁর সখীর নাম ফতিমা। এখানেই রাম শরিয়তের বিধান টেনে নারীর এক স্বামীর কথা বলেন, পালটা শূর্পণখার উত্তর, শরিয়ত তাহলে পুরুষের ক্ষেত্রে একাধিক স্ত্রীকে মান্যতা দেয় কেন? লোকমুখে ঘুরে বেড়ানো এই রামকাহিনির শ’দেড়েক পঙ্ক্তি মুখস্থ ছিল কেরলের এক ব্রাহ্মণ কিশোরের। সেই টি এইচ কুনহিরামন নাম্বিয়ার-ই পরে লোকসংস্কৃতি গবেষক হিসেবে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন, আর তিনিই এই রামায়ণ সংরক্ষণে উদ্যোগী হন। সাহিত্যিক এম এন কারাসেরি পুরোটা লিপিবদ্ধ করে কুরিমানম্ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন মাপ্পিলা রামায়ণ-কে।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: যুদ্ধের দিনে প্রেম… কম্বনের রামায়ণ যেন ব্যক্তিগত ঈশ্বরীতলার রূপকথা
আবার ‘আ ভিজিট টু ইউরোপ’ বইয়ে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় লেখেন এমন এক রামকথার কাহিনি, যা তিনি শুনেছিলেন এডেন বন্দরে। সে গল্পে আছেন রাম হায়দার, তাঁর পত্নী, আর দুই সন্তান লথ ও কুশ। রামের স্ত্রীকে অপহরণ করে দশশির রাবণ। তাঁকে আবার উদ্ধার করেন বানররূপী হনবীত। আরবি ভাষার এই লোককাহিনি প্রচলিত রয়েছে ইয়েমেনে।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: কৃত্তিবাস থেকে সুকুমার, বহু ধারায় খরস্রোতা বাংলায় রামায়ণ চর্চা
সাম্প্রতিক কালে রামকে নিয়ে জয়ধ্বনি তুলে ক্রমশ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে যে তিনিই আদিপুরুষ। তাঁর ‘রামায়ণ’ যেন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীরই দখলে থাকার কথা। কিন্তু ভারতবর্ষ তার বৈচিত্র্যকে চারিয়ে দিয়েছিল মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানেও। এ দেশের আত্মায় যে মিলনের সুর, সেই সুরকেই ধারণ করে আছে মহাকাব্য রামায়ণ। সেখানে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যেও বেড়া নেই কোনও। আর রামায়ণকে কেন্দ্র করে এমন করেই এক অভিনব সমন্বয়ের পাঠ দিয়েছে এই দেশ।