একদিকে নবান্ন, অন্যদিকে ইতু। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে শীতকাল শুরু হয় এভাবেই। অদ্ভুত ভাবে দুই ব্রতের নিয়ম কিছুক্ষেত্রে এক। প্রশ্ন হচ্ছে, এর কারণটা কী? নবান্নের সঙ্গে নাহয় সরাসরি দেবী লক্ষ্মীর যোগ রয়েছে। কিন্তু ইতু, এতো সূর্যদেবের পুজো। তাহলে ইতু পুজোর নিয়মেও কীভাবে জুড়লেন দেবী লক্ষ্মী? আসুন শুনে নিই।
অঘ্রাণ মাস। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে নতুন ধানের সুবাস। প্রচলিত রীতি মেনে যা সবার আগে ব্যবহার হবে দেবী লক্ষ্মীর প্রসাদে। বাংলার নিজস্ব এই নবান্ন ব্রতের নিয়ম কমবেশি সকলেরই জানা। কিন্তু প্রায় একই নিয়মে ঘরে ঘরে পালিত হয় আরও এক ব্রত। হিসাবমতো যা আসলে সূর্যের আরাধনা। কিন্তু সেখানেও রীতিমতো প্রভাব রয়েছে দেবী লক্ষ্মীর।
আরও শুনুন: শীতের দুয়ারে বর্ষাকাল! অঘ্রান-মাঘে বৃষ্টি হলে কী হয়, উত্তর আছে খনার বচনেই
কথায় আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এর মধ্যে শীতকালের দুই মাসের। যার শুরুটা হয় নবান্ন দিয়ে আর শেষ হয় পিঠে-পুলির সঙ্গে। কিন্তু ঠিক এই দুয়ের মাঝে আরও এক ব্রতের চল রয়েছে বাংলার ঘরে ঘরে। যেখানে পীঠে খাওয়ারও যেমন নিয়ম রয়েছে, তেমনই নবান্ন-র মতো নতুন ফল নতুন সবজি নতুন গুড়, সবই প্রয়োজন। ঠিক ধরেছেন কথা বলছি ‘ইতু’ পুজো সম্পর্কে। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় এই ব্রত। কোথাও আবার গোটা মাস জুড়েই ‘ইতু’ ব্রতর অঙ্গ হিসেবে বিশেষ নিয়ম পালন করতে হয়। মনে করা হয়, ‘ইতু’ শব্দটা ‘মিতু’ বা ‘মিত্র’ থেকে এসেছে। যা আসলে সূর্যের অপর নাম। তাই ‘ইতু’ বলতে সূর্যদেবকেই বোঝানো হয়। পুজো হয় অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার। ব্রতীকে বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে থাকতে হয় সারাদিন। ব্রতে কোনও মূর্তি পুজোর চল নেই। আরাধনা করা হয় মাটির সরাকে। তার সঙ্গে ছোট ছোট ঘট থাকে। এগুলি সূর্যের বাহন ঘোড়ার প্রতীক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলার নিজস্ব যেসব ব্রত রয়েছে তার সবই প্রায় দেবী কেন্দ্রিক। সেক্ষেত্রে ইতু কীভাবে স্রেফ দেবতার পুজো হয়ে থেকে যায়?
আরও শুনুন: শস্য আর সূর্যদেবতার আরাধনা মকর সংক্রান্তিতে, কীভাবে দিনভর চলে উদযাপন?
এখানেই ইতু-র সঙ্গে মিশেছেন দেবী লক্ষ্মী। ব্রত কথায় সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও, ‘ইতু’ পুজোর সময়টা দেখলে খানিক আন্দাজ করা যায় দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে এর যোগ ঠিক কোথায়। সবটাই নতুন ফসলের সঙ্গে সম্পর্কিত। শীতের এই সময়টা নতুন ধান ওঠার। গ্রাম বাংলা ভরে ওঠে সেই সুবাসে। সেখানে কোনও পুজো হলে শস্য দেবী কীভাবে ব্রাত্য থাকেন! তাই নবান্ন হোক বা ইতু, সবেই জুড়েছে শস্য দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা। আবার সূর্য উর্বরা শক্তির আধার। তাঁকে প্রসন্ন করার রেওয়াজ প্রায় সব জাতির মধ্যেই রয়েছে। বাঙালির সেই সূর্য পুজো হল ‘ইতু’-র ব্রত। একইসঙ্গে সূর্যের দাক্ষিণ্যে, ধান ও সমৃদ্ধি রূপিনী দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা। এবার আসা যাক ব্রত কথার প্রসঙ্গে। সেখানে উমনো-ঝুমনো নামে দুই বোনের কাহিনী শোনা যায়। ইতুর কৃপায় কীভাবে তাদের জীবনে বদল এল সেই কাহিনী প্রচলিত ব্রতকথা হিসেবে। সেখানেও স্পষ্ট দেখা যায়, ব্রত করলেই ধন সম্পত্তি বা যাবতীয় সাংসারিক সুখ লাভের বর্ণনা। গ্রামের দিকে এমনটাও প্রচলিত রয়েছে, ইতুর ব্রত করলে কুমারী মেয়ে বর পাবে আর সধবা পাবে সন্তান। এই প্রসঙ্গেও একথা সহজেই বলা যায়, ইতু-র ব্রত পালনের আসল উদ্দেশ্য সংসারের সার্বিক মঙ্গল। এক কথায় বলতে গেলে ঘরে লক্ষ্মী স্থাপন। তাই ব্রতের নিয়মেও মিলেমিশে এক হয়েছে লক্ষ্মী পুজোর আচার। এই পুজোতেও নতুন ফ, সবজি, চাল, গুড় এইসব লাগে। আবার বিশেষ এক ধরনের পীঠে খাওয়ারও নিয়ম রয়েছে ইতু পুজোয়। যদিও ব্রতের নিয়ম অঞ্চল ভেদে ভিন্ন হতেই পারে। তবে প্রচলিত নিয়ম এমনই। সূর্য হোক বা লক্ষ্মী সকলকে তুষ্ট রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য সংসারের মঙ্গলকামনা। দীর্ঘদিন ধরে যা পালন করে আসছেন বাংলার মেয়েরা।