যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের উদার অমৃতকথা আমাদের পৌঁছে দেয় জীবনের সার্থকতায়। ঈশ্বরে মন রেখেই সাংসারিক কর্তব্যপালনের যে অমোঘ পথ তিনি দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাই-ই আজও আমাদের পাথেয়। সেই কথাই উঠে এসেছে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরমপদকমলে’ গ্রন্থে। আসুন শুনে নিই সেই অমৃতপ্রসঙ্গ।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: উদ্বোধন কার্যালয়
জীবনে হতাশা আছে। বিষণ্ণতা আছে। আবার তা দূর করার উপায়ও আছে। প্রত্যাশা থেকেই এই বিষের জন্ম। তাই সাধুজন বলেন প্রত্যাশা না রাখতে। সংসারের মূল সত্যটা, নিজের পরিচয়টা বুঝতে জানলে, ধারণার জট কেটে যায়। ঠাকুরের সেই দর্শন খুব প্রাঞ্জল ভাবে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বিখ্যাত বই ‘পরমপদকমলে’-তে ‘ডুডুও খাব টামাকও খাব’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন,
‘প্রত্যাশা থেকেই হতাশা। মনে মনে অনেকের কাছেই আমাদের অনেক পাওনা। এক চুল এদিক ওদিক হলেই জগৎ বিষণ্ণ। আমরা সকলেই অদ্ভুত এক দেনাপাওনার জগতে বিচরণ করছি। প্রতি মুহূর্তে জগৎকে নিজের মনের মতো করে সাজাচ্ছি। পরমুহূর্তেই বাস্তব এসে সে চেহারা গুঁড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বারে বারে মোহ ভঙ্গ হলেও মোহগ্রস্ত মানুষের চেতনা হয় না।
মানুষ বিচক্ষণ প্রাণী। যুক্তিতর্কে পারঙ্গম। বিচার-বুদ্ধি আছে। তবু পৃথিবী যা নয় তাই ভেবে অকারণে কষ্ট পায়। যা অনিত্য তাকে আঁকড়ে ধরে দীর্ঘ স্বপ্ন দেখার ব্যর্থ চেষ্টায় একদিন ঘুম ভেঙে যায়, তখন আর নামরূপ থাকে না। বর্তমানের পরিচয় বুঝে যায়। আবার নতুন শরীর, নতুন পরিচয়, নতুন পরিবেশ। জীবমুক্তি, সে অতি দূরের কথা।
আমার দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ, নাক, কান, খাড়া হয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গি, কিছু গ্রহণের পথ, কিছু বর্জনের পথ, ভাষা, সংলগ্ন চিন্তা, এই দেখিয়েই মানুষের ছাড়পত্র পেয়ে গেছি। প্রকৃত মানুষ কজন? ঠাকুর বলতেন, ‘মানুষ’ শব্দের অর্থ মান হুঁশ। হুঁশ মান তবেই না তুমি মানব। জন্মেই আমরা বেহুঁশ। চারপাশে থরে থরে মায়ার আয়োজন। বর্ণ-বিপুল প্রকৃতি। ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তিহীন চাহিদা। ষড় রিপুর অবিরত টঙ্কার। কে আমি? কোথায় আমি? চলেছি কোথায়? কিছুই জানি না। আমার একটা নাম আছে। একটা পদবী ঝুলছে নামের পিছনে। পিতা, মাতার পরিচয় জানি। বাকিটা বংশগতির ধারায় ভেসে চলা।
ঠাকুর বলতেনঃ “অন্নগত প্রাণ। মৃত্তিকার আকর্ষণে, সংসার বলয়ে বল্লাহারা জীবন ঘুরছে, চোখ বাঁধা কলুর বলদের মতো।” উটের আহার কণ্টকাকীর্ণ পাতা। জিভ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত তবু সেই আহারেও কী আনন্দ! এত দুঃখের, এত হতাশার পৃথিবী তবু ছেড়ে যাবার সময় সে কী আকুলতা।’
ঠাকুরের এই দর্শন ধরে এগোলেই হয়তো আমরা প্রত্যাশিত উত্তর পাব।অন্ধকারের উৎস থেকে তখনই দেখা মিলবে আলোর।
(চলবে)