যৌনতা যেখানে ট্যাবু, প্রকাশ্যে যৌন চর্চাও সেখানে সুলভ নয়। অন্তর্জালের পর্নোগ্রাফির ভাণ্ডার যখন হাতের মুঠোয় আসেনি, সেসময় বাঙালিকে সেই নিষিদ্ধ যৌনতার স্বাদ দিয়েছিল হলুদ বই। যার মলাটে হাতছানি দিত খোলামেলা নারীশরীর, আর পাতায় পাতায় থাকত শরীরী বর্ণনার শিহরন। সেই ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের বাঁকেই নজর রাখলেন বিবস্বান।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
এ এক ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের গল্প। মোবাইলে মোবাইলে তখনও ইন্টারনেট সুলভ হয়ে ওঠেনি, এমন কি VCR প্লেয়ারও ছিল হাতে গোনা কয়েকটি বাড়িতে। সিডি ভাড়া পাওয়া যেত পাড়ার পানের দোকানে। তবে সেই সিডি দেখার উপায় বড়ো সহজ ছিল না। দরকার VCR আছে এমন বাড়ি, সেটাও থাকতে হবে ফাঁকা। এর থেকে অনেক সোজা ছিল হলুদ মলাটের বই। মেলার মাঠে, রাস্তার ধারে, খোলা মেলা ভাবেই বিক্রি হত সেগুলো। কাঁচা হাতে আঁকা, সস্তা ছাপায় আকর্ষক ছবি থাকত মলাটে।
এতক্ষণে সবাই বুঝে গেছেন আসলে ঠিক কী নিয়ে কথা হচ্ছে। আমাদের দেশে যৌনতা একটা ট্যাবু। যৌন শিক্ষা কোনও সিলেবাসেই সেভাবে পড়ানো হয় না। যৌনতা নিয়ে ঢাক ঢাক, গুড় গুড় করতে করতে আমরা যেন কবে ভুলে গেছি এই দেশ কামসূত্রের দেশ। কোণার্ক খাজুরাহের দেশ। বিদ্যাসুন্দরের দেশ। যৌনতা এ দেশের সংস্কৃতিতে যে কেবল স্বাভাবিক তাই নয়। সুন্দর। তাই তো ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আদি রস শৃঙ্গার। কালিদাসের শৃঙ্গাররসাষ্টক, কুমারসম্ভব, শ্রুতবোধ থেকে শুরু করে ঋতুসংহার সবই আসলে সেই সুন্দরের উদ্যাপন। ইংরেজ চলে গেছে সেই কবে! আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে মান্ধাতার বাবার আমলের ভিক্টোরীয় নীতিবোধ। আমরাও ঔপনিবেশিক অভ্যাসে সগৌরবে বয়ে নিয়ে চলেছি সেইসব।
কিন্তু যা সহজ স্বাভাবিক এক জীবনসত্য, তাকে যদি চাপা দিয়ে রাখা হয় তাহলে তা প্রকাশিত হবেই কোনও না কোনও বাঁকা পথে। পর্নোগ্রাফিক হলুদ বই কি সেই অবদমনের ফল?
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: সংখ্যায় অসংখ্য পুজোসংখ্যা, রামের অকালবোধনে রাবণই হবেন পাঠক!
শরৎচন্দ্র হরিদাসের গুপ্তকথা সম্পর্কে লিখেছিলেন, “স্কুলের পাঠ্য বই তো নয়। ওগুলো বদ ছেলের অপাঠ্য পুস্তক। তাই পড়বার ঠাঁই করে নিতে হোল আমার বাড়ির গোয়াল ঘরে।” যে সমাজে হরিদাসের গুপ্তকথাও লুকিয়ে পড়তে হত সেই সমাজে ওইসব হলুদ মলাটের বই যে কতটা অস্পৃশ্য ছিল তা তো বলাই বাহুল্য। উত্তরের জানলা যদি কোনও অলীক একজটা দেবীর জুজু দেখিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়, তাহলে তো বালক সুভদ্রদের কৌতূহল হবেই সেই জানলাটা একটুখানি খুলে বাইরেটা দেখে নেওয়ার। সুভদ্ররা বয়সোচিত কৌতূহলে জানলাটা খুলবে। আর তারপরে ডুবে যাবে এক অপরিসীম পাপবোধে। এইভাবেই কত শিশুর স্বাভাবিক যৌন বিকাশ ব্যহত হয়। আর হইহই করে চলতে থাকে হলুদ বইয়ের অস্বাভাবিক যৌনতার বিপণন। যা ছিল সহজ স্বাভাবিক আর সুন্দর, নিষেধের কৃপাদৃষ্টিতে সেই হয়ে উঠল পণ্য।
এই পণ্যায়নের ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের চোখ ফেরাতে হয় উনিশ শতকের দিকে। রেভারেন্ড জেমস লঙ ১৮২০ সনে মুদ্রিত উনিশটি বাংলা বইয়ের যে তালিকা রচনা করেছেন, তার মধ্যে চারখানা আদিরসাত্মক। নাম- আদিরস, রতিমঞ্জরী, রতিবিলাস ও রসমঞ্জরী। ১৮৫৫ সনের আগেকার বছরগুলোয় ছাপা চোদ্দশ বাংলা বইয়ের যে তালিকা লঙ প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্যেও বেশকিছু আদিরসাত্মক বইয়ের উল্লেখ আছে। উল্লেখ আছে দুই বছর পরে তৈরি তাঁর অন্য তালিকাটিতেও। লঙের তৈরি ১৮৫৫ সনের তালিকা থেকে কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- কামশাস্ত্র, লক্ষ্মী-জনাৰ্দ্দন বিলাস, প্রেম অষ্টক, প্রেমবিলাস, প্রেম নাটক, প্রেমতরঙ্গ, প্রেমরহস্য, বেশ্যারহস্য, সম্ভোগ রত্না রসতরঙ্গিণী, রতিকেলি, রসরত্নাকর, শৃঙ্গার রস, স্ত্রীচরিত্র ইতাদি। বলতে গেলে বটতলার ছাপাখানার আদি যুগ থেকেই ছাপা হচ্ছিল এসব বই। অর্থাৎ উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই। একটি বই সম্পর্কে লং মন্তব্য করেছেন, ‘ষোলখানি নোংরা ছবিসহ’। কাঠের ব্লকে ছাপা এই ছবিগুলি ছিল এই ধরনের বইয়ের অন্যতম আকর্ষণ। কেবল বই নয়, অনেক পত্রিকাও এই সময় প্রকাশিত হত প্রায় একই উদ্দেশ্যে। সম্বাদ রসরাজ, সম্বাদ ভাস্কর, সম্বাদ সুধাকর প্রভৃতি পত্রিকার কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। উনিশ শতক পেরিয়ে বিশ শতকেও এই ধরনের পত্রপত্রিকা দেখা যায়। বিশ শতকের ছয়-সাতের দশকেই বাজারে আসতে শুরু করে জীবনযৌবন, রূপোলি প্রজাপতি, দেহমন, তনুমন প্রভৃতি পত্রিকা।
আরও শুনুন: বাংলা গানে-সিনেমায় ‘কুমার’-এর ছড়াছড়ি, তবে সাহিত্যে স্বপনকুমারই একমেবাদ্বিতীয়ম
এই সময়েই এক ধরনের চটি বই প্রকাশিত হতে দেখা যায়, যেগুলি আগাগোড়া সাধুভাষায় লেখা। উদয়ন সন্ন্যাসীর লেখা এইধরনের একটি চটি সিরিজ- ভাড়ার বাড়ি, কন্যাকুমারী এবং ষোল বছরের মেয়ে। চৌরঙ্গী, লেডিস ট্রাম প্রভৃতিও এই সময় প্রকাশিত হতে থাকে। লক্ষণীয়, এই সমস্ত বইয়ের গল্প কিন্তু মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক। এবং সামাজিক বদলের একটা ছবি খুব অস্পষ্টভাবে হলেও এই সমস্ত বইয়ে ধরা পড়েছে। চৌরঙ্গীতে কলকাতায় নতুন শুরু হওয়া ম্যাসাজ পার্লারের বিবরণ মেলে। লেডিস ট্রামে পাওয়া যায় চাকুরিরতা স্বাধীনচেতা মেয়েদের। কিন্তু এই পত্রিকাগুলো আস্তে আস্তে তাদের বৈচিত্র্য হারাচ্ছিল। আশির দশকের নরনারী, যৌবন, নায়িকা, রমণী, সঙ্গিনী, নতুন জীবন প্রভৃতির ভেতরে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না ষাট-সত্তরের বিষয় বৈচিত্র্য। ইরোটিকাও যে একধরনের সাহিত্য, কেবল যৌনক্রীড়ার বিবরণ দিতে থাকলে যে তা একসময় একঘেয়ে হয়ে যেতে বাধ্য এই সহজ কথাটি সেদিনের হলুদ বইয়ের লেখকেরা বুঝতে চাননি।
তারপর এল নব্বইয়ের দশক। ততদিনে হলুদ বইয়ের বাজার আস্তে আস্তে দখল করেছে নীল ছবি। মুক্ত অর্থনীতি এসেছে। পড়া থেকে দেখা আর শোনায় মানুষ আগ্রহী হয়েছে বেশি। অডিও ভিসুয়াল মাধ্যম যৌন ফ্যান্টাসিকে কল্পনার পরিশ্রম থেকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু এই সময়েও স্যাটারডে ক্লাব, দেহময় আগুন, নরনারী, প্রভৃতি বই প্রকাশ পেতে দেখা যাক। গবেষক অর্ণব সাহা দেখিয়েছেন, শিবা বা বিচিত্রবীর্য ছদ্মনামের আড়ালে যাঁরা এই ধরনের গল্প তখন লিখছিলেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের লেখাতেই ব্লু ফিল্ম দেখার প্রসঙ্গ কোনও না কোনও ভাবে আসছিল।
আসলে উনিশ শতকে ছাপাখানার যুগ শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রিন্ট মিডিয়ার এক বিশেষ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই হলুদ বইয়ের যাত্রা শুরু। এরপর যৌনতার পণ্যায়নের নানারকম বিবর্তন ঘটেছে। উনিশ শতক পেরিয়ে বিশ শতক হয়ে একুশ শতকে হলুদ বই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই। কারণ আমাদের হাতের সামনে চলে এসেছে আরও সুলভ এবং আরও আকর্ষক যৌন বিনোদনের মাধ্যম। কিন্তু হলুদ বইয়ের ধারা নিজের জৌলুস হারিয়ে আজও টিকে আছে।
সামগ্রিকভাবে হলুদ বইয়ের ইতিহাসের দিকে তাকালে একটা বিপদজনক প্রবণতা দেখতে পাওয়া যাবে। যৌনতার বর্ণনা বা অবৈধ যৌনতার বর্ণনা নানাদেশের সাহিত্যেই প্রচুর পাওয়া যায়। আমাদের দেশের সাহিত্যেও তো তা দুর্লভ নয়! কিন্তু হলুদ বইয়ের যৌনতার বিবরণ মূলত মেল ফ্যান্টাসিকে তৃপ্ত করার জন্যই। নারী দেহ এইখানে শুধুই পণ্য। নারী শরীরের একমাত্রিক বর্ণনা প্রায় সমস্ত স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে যায়। অতিরঞ্জিত বিবরণের মাধ্যমে নারী শরীরকে পুরুষের যৌনতৃপ্তির এক যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবা হয়ে ওঠে না। ফলে কৈশোরের যৌনবোধ গড়ে ওঠার সময় এই সমস্ত বই হাতে এসে পড়লে কিছু অনিবার্য সমস্যারও সৃষ্টি হয়। যৌনতাকে জীবনের স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যে উচিত নয় সেই বোধ অনেক সময়েই গড়ে ওঠে না। আবার উলটোদিক থেকে ভাবলে মনে হয়, হলুদ বই একভাবে আমাদের সমাজের এক তির্যক প্রতিচ্ছবিও তুলে ধরে। যে সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, যে সমাজ জানে না যৌনতার প্রাথমিক শর্ত পারস্পরিক সম্মতি, যে সমাজের পুরুষেরা ‘না’ শুনতে অভ্যস্ত নয়, সেই সমাজের যৌন ফ্যান্টাসিকেই তো তুলে ধরে এইসমস্ত হলুদ বই! হলুদ বই দেখে আমরা যারা নাক কোঁচকাই, তারা কি কোনও ভাবে এক আয়নার সামনে এসে দাঁড়াই? ভেবে দেখার সময় এসেছে।
কৃতজ্ঞতা:
যৌনতার রূপ ও রূপান্তর, সোমব্রত সরকার।
বাঙালির যৌনচর্চা : বটতলা থেকে হলুদ বই, অর্ণব সাহা।