‘আমি ঝুলন গোস্বামী হতে চাই’- বল হাতে যে কিশোরী আজ হাত ঘোরাচ্ছে তার দিনের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসে এই অমোঘ বাক্য। নানাবিধ হোঁচট ঠোক্করে আজ যারা রক্তাক্ত হয়ে খানিক হতোদ্যম, তাদের কানে কানে মন্ত্রণা দেয় ওই স্বপ্ন। ঝুলন গোস্বামী শুধু একজন প্রাক্তন ক্রিকেটারের নাম নয়, ঝুলন আসলে মফস্বলের ঘরে ঘরে জন্ম নেওয়া এক স্বপ্নের নাম। লিখছেন সুলয়া সিংহ।
‘আমি ঝুলন গোস্বামী হতে চাই’- বল হাতে যে কিশোরী আজ হাত ঘোরাচ্ছে তার দিনের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসে এই অমোঘ বাক্য। ছোট ছোট মাঠে ছাপোষা সব টুর্নামেন্টের স্থানীয় সংবাদের নেপথ্যে নেপথ্যে ঘুরে ফেরে সেই স্বপ্ন। নানাবিধ হোঁচট ঠোক্করে আজ যারা রক্তাক্ত হয়ে খানিক হতোদ্যম, তাদের কানে কানে মন্ত্রণা দেয় ওই স্বপ্ন। ঝুলন গোস্বামী তাই শুধু একজন প্রাক্তন ক্রিকেটারের নাম নয়, ঝুলন আসলে মফস্বলের ঘরে ঘরে জন্ম নেওয়া এক স্বপ্নের নাম।
আরও শুনুন: জন্মদিনের সেঞ্চুরি ঘটনা মাত্র! আসলে প্রতিটি সেঞ্চুরিই বিরাটের জন্মদিন
একজন উঠতি ক্রিকেটারের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠার নেপথ্য়ে থাকে দীর্ঘদিনের তপস্যা। নিরলস পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, অদম্য় জেদ আর প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে সব প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর এক সংগ্রামী কাহিনি। ঝুলন গোস্বামীও আগামীর অনুপ্রেরণা হতে নিজের প্রথম ভালোবাসার প্রতি সব উজাড় করে দিয়েছেন। এককালে বিশ্বকাপের ‘বল গার্ল’ থেকে বাড়ির শোকেসে সাজানো অর্জুন পুরস্কারের জার্নিটা নেহাত পাপড়ি দিয়ে তো সাজানো ছিল না।
আর পাঁচজনের মতোই ছোটবেলায় ছোট ছোটখাটো ব্যাপারগুলোয় খুশি হত মেয়েটা। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে ভালবাসত। বৃষ্টিতে একা একা হাঁটতে আনন্দ পেত। কোনওদিন সেলিব্রিটি হওয়ার স্বপ্ন দেখেনি। বরং নিজের ইচ্ছেগুলোকে অতি যত্নে লালন করেছিল। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, চোয়াল-চাপা জেদ একদিনের জন্যও ফিকে হয়ে যেতে দেয়নি। চাকদহের বাড়ি থেকে কিট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভোর ৪.৪৫-এর লোকাল ট্রেনে চেপে জানলার বাইরে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখত সেদিনের আনকোরা মেয়েটা। জানত, স্বপ্ন না দেখলে পূরণ হবে কীভাবে। আজ সেই মেয়েই অন্যকে স্বপ্ন দেখার সাহস দিয়েছে। আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। তাই তো আজ ময়দানে প্র্যাকটিসরত মহিলা জোরে বোলাররা বলে ওঠে, ‘আমি ঝুলন গোস্বামী হতে চাই’। ঝুলন গোস্বামী শুধু একজন ক্রিকেটার নয়, বরং হার-না-মানা লড়াইয়েরই নাম।
আরও শুনুন: একটা বলেই ২৮৬ রান! ক্রিকেট মাঠ সাক্ষী থেকেছে এমন ঘটনারও
মহিলা ক্রিকেটের মহিরুহ তিনি। অথচ ছোটবেলায় প্রথম পছন্দ ছিল ফুটবল। কিন্তু ১৯৯২ বিশ্বকাপ বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন। জেন্টলম্যানস গেমের প্রেমে পড়েছিলেন। ১৯৯৭ বিশ্বকাপে ছিলেন বল গার্ল। পাঁচ বছর পর সেই মেয়েই গায়ে চাপিয়েছিল দেশের জার্সি। বাকিটা তো ইতিহাস। দীর্ঘ ২০ বছর ২২ গজে বল হাতে রাজত্ব করেছেন। তাঁর গতির কাছে নত হয়েছে ব্যাটারের ঔদ্ধত্য। আর ঝুলনের ঝুলিতে উপচে পড়েছে রেকর্ড। রেকর্ডের পিছনে কি ছুটেছিল ‘চাকদা এক্সপ্রেস’! বোধহয় না। বরং যে ছুটতে জানে, একদিন সেই মেয়ের পায়ের কাছেই এসে ঠাঁই নিয়েছে অনুগত রেকর্ডবুক। বিশ্ব দেখেছে, সে ‘যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে।’ পরিসংখ্যান বলে, মহিলাদের ক্রিকেটে ঝুলন গোস্বামী সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। আবার ২০০ ওয়ানডে খেলার মালকিনও তিনিই। আসলে ঝুলন গোস্বামী শুধু একজন ক্রিকেটার নয়, বরং রক্ত-ঘামে গদ্য লিখে জীবনে সাফল্যের শৃঙ্গবিজয়েরই অন্য নাম।
একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শচীন তেণ্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়দের খেলা দেখেই তো দেশের হয়ে খেলার ইচ্ছে হত। অদ্ভুত সমাপতন! যে-লর্ডসে একদিন স্বপ্নের অভিষেক হয়েছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের, তাঁর ব্যাট হয়ে উঠেছিল গাণ্ডীব, সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে নিজের আবির্ভাব ঘোষণা করেছিলেন মহারাজ- সেই লর্ডসেই আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন ঝুলন। ঐতিহাসিক লর্ডসের ২২ গজেই যেন সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার বৃত্ত পূরণ হয়। ক্রিকেট মাঠের সবুজ গালচেতে হাসনুহানার মতো নিজের সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছেন। ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু মণিমাণিক্য। তাঁর স্বপ্নের স্পেলে আজও মোহিত ক্রিকেটপ্রেমীরা। সেই খোঁজেই তো ছুটে আসে আগামীরা। আর একবুক স্বপ্ন নিয়ে বলে ‘আমি ঝুলন গোস্বামী হতে চাই’।
ঝুলন গোস্বামী শুধু একজন ক্রিকেটার নয়, বরং রক্তমাংসের এক অন্তহীন এক রূপকথারই অন্য নাম।