শিব ছাড়া যেমন দেবীকে ভাবা যায় না, তেমনই দেবীর পদতলে সবসময় উপস্থিত শিবা বা শৃগাল। কিন্তু শিবার সঙ্গে দেবীর কী সম্পর্ক? শুনে নেওয়া যাক সে কথা। লিখছেন সৌভিক রায়।
দেবী কালী ছিলেন শ্মশানবাসিনী। নির্জনে তাঁর আরাধনা করতেন সাধক-তান্ত্রিকরা। কালে কালে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, রামপ্রসাদ সেনরা তাঁকে বাংলার, বাঙালির ঘরের দেবী করে তুলেছেন। শিব ছাড়া যেমন দেবীকে ভাবা যায় না, তেমনই দেবীর পদতলে শিবার উপস্থিতিও উজ্জ্বল। কিন্তু শিবার সঙ্গে দেবীর কী সম্পর্ক? আদপে শিবা কে?
আরও শুনুন: লক্ষ্মী বা সরস্বতীর মতো, কালীপুজোও কি বাড়িতেই করা যায়?
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে রয়েছে, দেবী চণ্ডী যখন আবির্ভূতা হচ্ছেন, তখন দেখা যাচ্ছে তিনি শিবা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে শিবজায়া হয়ে উঠছেন শিবাদূতী। শিবা কি তাহলে শিবের অনুচর? বলা হচ্ছে,
‘ততো দেবীশরীরাত্তু বিনিষ্ক্রান্তাতিভীষণা।
চণ্ডিকাশক্তিরত্যুগ্রা শিবাশত-নিনাদিনী।।’
অর্থাৎ দেবীর শরীর থেকে শত শৃগালের ন্যায় গর্জনসৃষ্টিকারী চণ্ডিকাশক্তি আবির্ভূতা হলেন।
কালীর সঙ্গে শৃগাল জড়িয়ে গেল কী হিসেবে? হতে পারে কালীর পাশে বা পদতলে থাকা শৃগাল, দেবীর ভৈরবের সহচর। নতুবা ভৈরবের আরেকটি রূপ শৃগাল। শিব এবং শিবা সম্ভবত একে অন্যের পরিপূরক। বাংলার শিব শ্মশানবাসী, শিবাদের বিচরণক্ষেত্রও শ্মশান। উভয়ই দেবীর পদতলে অবস্থান করে। দেবীর দক্ষিণ পা শবের উপর এবং বাম পা শৃগালের উপর থাকে-
‘নিক্ষিপ্য দক্ষিণং পাদং সন্তিষ্ঠৎ কুণকোপরি।
বামপাদং শৃগালস্য পৃষ্ঠে ফেরুশতৈর্বৃতম্।।’
রাঢ় বাংলার বহু কালীমন্দিরে পুজোর পর গভীর রাতে শিবাভোগ দেওয়া হয়। দেবীকে নিবেদন করা ভোগ পুরোহিত শ্মশানে গিয়ে শিবাদের খাইয়ে আসেন। দুর্লভা কালী মন্দির, যজ্ঞেশ্বরী পীঠ, কয়েকটি সতী পীঠে এখনও এই রীতি দেখা যায়। দেবী কেবল একা খাচ্ছেন না, ভক্তের দেওয়া নৈবেদ্য থেকেই ভৈরবের বা ভৈরবের সহচরদের ক্ষুধা নিবৃত্তির ব্যবস্থা করছেন, যেন বাঙালি পরিবারের চিত্র।
আরও শুনুন: বসন পরো মা… মাতৃস্বরূপা কালী কেন নগ্নিকা?
বাংলার এক ছড়াও অদ্ভুতভাবে শিব আর শিবাকে মিলিয়ে দেয়। ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান/ শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান’- এই ছড়াটির অন্য একটি সংস্করণ দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার সংগ্রহ করেছিলেন। ছড়ার সেই সংস্করণটিতে শিব ও কন্যার বদলে রয়েছে শিয়ালের উল্লেখ। ছড়াটি এইরকম-
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান
শিয়ালের বিয়ে হবে তিন শিয়ালে দান।
এক শিয়ালে রাঁধেন বাড়েন এক শিয়ালে খান।
আরেক শিয়াল গোঁসা করে বাপের বাড়ি যান।’
ওপার বাংলাতেও এই ছড়ার আরেকটি সংস্করণে শিবের বদলে শিয়ালকে পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের সংস্করণটি হল –
‘এক ছিয়ালি রাঁন্ধে বাড়ে দুই ছিয়ালি খায়।
ঠাকুর বেটা জগন্নাথ ঘোড়াতে চড়ি যায়।’
দুই বাংলার লোকজ ছড়ায় এইভাবেই শিব ও শিবা মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছেন।
দেবী কালী, মৃত্যুর দেবী। মৃত্যুতেই শেষ হয় যুগ, অর্থাৎ কাল। কালকে জয় করেই দেবী কালী হয়েছেন। অন্যদিকে, শিব স্বয়ং মহাকাল, তিনি শ্মশানে থাকেন, তাঁর ইচ্ছেতেই জীবের বিনাশ হয় অর্থাৎ প্রাণ যায়। শিবার আবাসভূমিও শ্মশান। শ্মশানেই মৃত্যুর পর দেহ বিলীন হয়। আবার মৃত্যুর এক পক্ষকালের মধ্যে শ্রাদ্ধ সেরে, সেইদিন সন্ধ্যায় মৃতের উদ্দেশ্যে আহার নিবেদন করা হয়। সরায় করে অন্ন, মৃত ব্যক্তির পছন্দের ব্যঞ্জন নিবেদন করা হয়। এককালেও তাকেও বলা হত শিবাভোগ। মনে করা হত, যার উদ্দেশ্যে খাবার দেওয়া হচ্ছে তিনি শৃগালের বেশে এসে তা গ্রহণ করেন। এইভাবেই হয়তো বাংলার রীতিনীতি ও লৌকিক সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছে শিব ও শিবা।