সংবিধান সংশোধন নতুন কিছু নয়। তবে এর থেকে প্রশ্ন জাগে, দেশের সংবিধানের মধ্যে কি মৌলিক কোনও দুর্বলতা আছে! সেই কারণেই বারবার সংশোধন জরুরি হয়ে পড়ছে? এবার এই বিষয়েই মুখ খুললেন কংগ্রেস নেতা তথা লেখক শশী থারুর। কী বললেন?
সংবিধানে সংশোধনীর প্রস্তাব প্রায়শই আসে খবরের শিরোনামে। নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে কোনও কোনও সংশোধনী গ্রহণও করা হয়। এবং তা দেশের স্বার্থেই। অনেক সময়ই তাই প্রশ্ন জাগে যে, দেশের সংবিধানের মধ্যে কি তাহলে মৌলিক কোনও দুর্বলতা আছে! সেই কারণেই বারবার সংশোধন জরুরি হয়ে পড়ে? এবার এই বিষয়েই মুখ খুললেন কংগ্রেস নেতা তথা লেখক শশী থারুর।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি সংবিধানের মৌলিক লক্ষণটিকেই আর একবার সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। সমতা। সৌভাতৃত্ব। ভারতীয় বোধ। এই তিনটি বিষয়ের উপর একেবারে গোড়া থেকেই জোর দিয়েছে দেশের সংবিধান। ভারতবর্ষ বহু ভাষাভাষি দেশ। বহু মত, বহু ধর্মভাবনা, বহু পথের দেশ। জাতি ভেদে সামাজিক অবস্থানের তারতম্য থাকা সত্ত্বেও, এই তিন অনুভবে যে ভারতবর্ষের নাগরিকদের এক সুতোয় বেঁধে ফেলা সম্ভব, এমনটাই মনে করেছিলেন সংবিধান প্রণেতারা। ১৯৪৯-এর নভেম্বরে বাবাসাহেব আম্বেদকর এই সূত্রটিকেই গোটা দেশের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তারপর বহু বছর কেটে গিয়েছে। বহু ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও এখনও সংবিধানই নাগরিকদের আশ্রয়। ভারতীয় সংবিধান তাই সংশোধনীর পথে হেঁটেও সেই মৌলিক জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়নি। বরং তা যাতে রক্ষিত হয়, সেই জন্যেই আসে সংশোধনের প্রস্তাবনা।
কেননা সময় বদলায়। বদল আসে প্রশাসনে। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল যখন দেশের শাসনভার গ্রহণ করে, তখন দেশ একটি নতুন অভিমুখে এগোতে থাকে। তবে রাজনৈতিক স্বার্থ যদি দেশের স্বার্থের থেকে বড় হয়ে যায়, তাহলেই গোল বাধে। সাম্প্রতিক অতীতেও বহুবার এ অভিযোগ উঠেছে। অনেকসময় বলা হয়েছে, মানুষের উপর অর্থাৎ দেশের নাগরিকের উপর যা যা নিয়মের ফাঁস চেপে বসছে, তাতে সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এই প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন থারুর। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বহুত্বের যে সামাজিক বুনন, তা যে বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা স্বীকার করেছেন তিনি। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের উপর, মুক্ত চিন্তাভাবনার উপরেও অনেক সময় নেমে এসেছে আঘাত। আর সেই সব বিরূপ পরিস্থিতিতেই দেশের সংবিধানই যেন নাগরিকদের আগলে রেখেছে। কেননা যে উদার গণতান্ত্রিকতার পরিসর সংবিধান আমাদের দেয়, তা কেউই কেড়ে নিতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় নিয়েই এক একটি দল ক্ষমতায় আসে। তার অর্থ এই নয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের বলে কেউ যা খুশি তা করতে পারে। গণতন্ত্রের রায়ের সেটাই মূল কথা যে, ক্ষমতা দখল করা মানেই যা ইচ্ছে তা করা স্বাধীনতা নয়। এবং নাগরিকদের এই অধিকার সুনিশ্চিত করে সংবিধানই।
তাহলে সংবিধানে সংশোধনী কি এর দুর্বলতা? থারুর বলছেন, একেবারেই নয়। বরং তা প্রমাণ করে যে আমাদের সংবিধান কোনও স্থির কাঠামো নয়। বরং তা একই সঙ্গে চলিষ্ণু এবং গ্রহিষ্ণু। সেই পরিসরের কথা অতীত প্রণেতারাই ভেবে গিয়েছেন। সংসদ দেশের ধারণাকে যে সময়মতো আরও প্রসারিত করতে পারে, তার প্রমাণ এই সংশোধনী। সময়ভেদে দেশের ধারনা অবশ্যই বদলায়। তবে দেশের আত্মা বদলায় না। সংবিধান সেই মূল জায়গাটি বজায় রেখেই সংশোধিত হয়। তা দুর্বলতা নয়, বরং তা সংবিধানের শক্তিরই পরিচায়ক। সে-কথাই মনে করিয়ে দিলেন শশী থারুর।