কলকাতা জুড়ে একদিকে যেমন কালীক্ষেত্রের ছড়াছড়ি, তেমনই একাধিক স্থাননামেও জুড়ে গিয়েছে কালী নাম। বোঝাই যায়, কলকাতার বুকে কালী আরাধনার চল বহুদিনেরই। কেমন ছিল পুরনো কলকাতার কালী আরাধনা? জানালেন সৌভিক রায়।
কালীঘাটের কালী থেকে ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী, বউবাজারের ফিরিঙ্গি কালী হোক বা ‘চায়না টাউন’-এর চিনে কালী, কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র কালীক্ষেত্র। স্থাননামেও কালীর প্রভাব লক্ষ করা যায়, কালীতলা, কালিকাপুর, কালীনারায়ণপুর। একদল গবেষকদের মতে কালী থেকেই কলকাতা নামের জন্ম, যদিও আধুনিক কলকাতা গবেষকরা অনেকেই এমনটা মনে করেন না। তবে কলকাতার বুকে কালী আরাধনার বয়স কমপক্ষ পাঁচ-ছ’শো বছর তো হবেই। জানেন, কেমন ছিল সেকালের কলকাতায় কালী আরাধনা?
আরও শুনুন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল ‘ভূত’, নাস্তানাবুদ হয়েছিল দুর্ধর্ষ নাৎসি বাহিনীও
সেকালের কলকাতায় বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ছিল কালী আরাধনার অন্যতম পীঠ। তখনও অবশ্য তার নাম বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট হয়নি। কলকাতাই শহরের রূপ পায়নি তখনও। জলা-জঙ্গল, জন্তু জানোয়ার আর ডাকাতের দখলে ‘সিটি অফ জয়’। আজ যেখানে এসপ্ল্যানেড চত্বর, সেখানে বইত গঙ্গা। নদী তীরবর্তী এলাকায় ছিল শ্মশান। সেসময় তান্ত্রিক-কাপালিকদের দাপট শুরু হল, মড়া নিয়ে শবসাধনা থেকে নরবলি, কী না দেখেছে কলকাতা! এ প্রসঙ্গে কালীঘাটের কথা এসে পড়ে। আজকের কালীঘাটের কালী ছিলেন উত্তর কলকাতায়। পোস্তার উত্তর দিকে দেবীর মন্দির আর পাকা ঘাট ছিল। মনে করা হয়, পাকা ঘাট থেকেই পাথুরিয়াঘাটা নামের উৎপত্তি। সেখান থেকে কাপালিকরাই দেবীকে তুলে নিয়ে যান কালীঘাটে। অনুমান করা যায়, স্থানান্তরের কারণ ছিল নির্বিঘ্নে কালী সাধনার জায়গা খোঁজা। কাপালিকরা দেবী কালীর সামনে নরবলি দিতেন। তখন উত্তর কলকাতা আস্তে আস্তে গড়ে উঠছিল, মানুষের ভিড় বাড়ছিল। এদিকে কালী সাধনার জন্য প্রয়োজন আড়াল-আবডাল। জঙ্গলে ঘেরা কালীঘাটকেই তাই বেছে নিলেন কাপালিকেরা। কালী, কলকাতা থেকে চলে গেলেন কালীঘাটে।
প্রায় দেড়-দুশো বছর কাপালিকদের দাপট সহ্য করেছে কলকাতা। কাপালিকদের বিতাড়িত করেছিলেন গৌড়রাজের সেনাপতি নরসিংহ। এর পিছনে রয়েছে লম্বা একখানা গল্প। কী সেই গপ্পো?
আরও শুনুন: ‘কালো মেয়ে’র গায়ের রং সবুজ! কী গল্প লুকিয়ে এই বিগ্রহের নেপথ্যে?
প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগের কথা। সাধনায় সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে কোনও এক তান্ত্রিক দেবী চামুণ্ডার কাছে একটি ছেলেকে বলি দেন। খবর পেয়ে ছেলেটির মা ছুটতে ছুটতে আসেন। এসে দেখেন সব শেষ। যুবতী বিধবার একমাত্র সম্বলের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। অন্যদিকে, তান্ত্রিকের জয়োল্লাস চলছে। ঠাকুরের কাছে মাথা ঠুকতে ঠুকতে অজ্ঞান হয়ে যান সেই যুবতী বিধবা, পদ্মা। জ্ঞান ফিরতেই দেখলেন লোভাতুর দৃষ্টিতে এক তান্ত্রিক তাকিয়ে রয়েছেন তার দিকে। সন্তানহারা মা বুঝলেন এই সুযোগ, বদলা নিতে হবে। অতএব ছলনার আশ্রয় নিলেন। প্রেমের জালে তান্ত্রিককে ফাঁসিয়ে ডেরা থেকে বের করলেন। তান্ত্রিকের চোখে তখন প্রেম আর কামনা, ফলে এগিয়ে গেলেন। সন্তানহারা বিধবা রমণী যে এমন ফাঁদ পাততে পারেন, তা আর আন্দাজ করতে পারেননি। কায়দা করে পদ্মা সেই তান্ত্রিককে নিয়ে গেলেন গৌড়াধিপতির নাগালে, বললেন সব ঘটনা। ওই তান্ত্রিককে কারাবন্দি করলেন গৌড়াধিপতি। সঙ্গে সঙ্গে নিজের এক সেনানায়ককে হুকুম দিলেন কাপালিকদের উচিত শিক্ষা দিতে।
খবর রটে গেল কলকাতাতেও। তান্ত্রিক-কাপালিকরা আর ঝুঁকি নিলেন না। চামুণ্ডার মূর্তি নিয়ে মানে মানে সরে পড়লেন ওই অঞ্চল থেকে। গৌড়রাজের আজ্ঞাবহ সেনাপতি নরসিংহ একখানা সেনাছাউনি গোছের ঠেক তৈরি করে ফিরে গেলেন। সেনা বিহনে তো আর সেনা ছাউনি হয় না, কিছু সেনাও থেকে গেলেন সেখানেই। তাঁরাই আস্তে আস্তে বসতি গড়লেন। কৃষিজীবী মুসলমানরা সেখানে এসে ভিড় বাড়ালেন। জীবিকার প্রয়োজনে গড়ে উঠল কসাইখানা। লোকজন কসাইয়ের পেশা গ্রহণও করল। জন্ম নিল কসাইটোলা। কলকাতার স্থাননামের ইতিহাস বলে, সমজাতীয় পেশার লোকদের বসতি টোলা নামেই পরিচিত ছিল। কলুটোলা, ব্যাপারিটোলা আজও সগৌরবে কলকাতায় বিদ্যমান। এই কসাইটোলা আজকের বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট হয়েছে দু’শো বছর আগে। ১৮৩৯ সালে মারা যান লর্ড বেন্টিঙ্ক, যাঁর হাত ধরে এসেছিল সতীদাহ নিবারণ আইন। বহু পরে তার নামে রাস্তা পায় মহানগর। ততদিনে রূপ বদলাতে শুরু করেছে তার। আজকের ঝকঝকে কলকাতার বুকে খুঁজে পাওয়া যাবে না সেকালের সেই কালীসাধনার কোনও চিহ্নও।