রাবণ বধের আগে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন রামচন্দ্র। আর কলকাতায় দেবীর অকালবোধন করেছিলেন, মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব। ১৭৫৭ সালে, সন্ধিপুজোর শুরু ও শেষে কামান দেগে মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব তাঁর নবনির্মিত রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজো শুরু করলেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর পাশাপাশি এই নাচঘরের নাচও, কিংবদন্তি হয়ে উঠল। আর দুর্গাপুজোর হাত ধরেই অভিজাত সমাজে ঠাঁই পেলেন নবকৃষ্ণ।
সবে শেষ হয়েছে পলাশীর যুদ্ধ। লর্ড ক্লাইভের হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা। এই বিশাল ভূখণ্ডের ভাগ্যবিধাতা আজ তিনিই! সেদিন পলাশীর যুদ্ধের নায়ক রবার্ট ক্লাইভ বিজয় উৎসব করবেন না তো কে করবে! কিন্তু সে নাহয় পরের কথা। এই বিপুল জয়ের পর তা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করবেন যে, সে উপায়ও নেই। কলকাতা দখলের পর তার একমাত্র গির্জাটাও যে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন সিরাজ-উদ-দৌলা। এই সময়, ক্লাইভকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন একজন। নবকৃষ্ণ দেব। তিনিই ক্লাইভকে বুদ্ধিটা দিলেন, নাকি ক্লাইভ তাঁকে প্ররোচিত করলেন তা ঠিক করে বলা মুশকিল, কিন্তু এক ঢিলে দুই পাখি মারার ব্যবস্থা হয়ে গেল। ঠিক হল দুর্গাপুজো করবেন নবকৃষ্ণ।
শিক্ষিত বাঙালি যুবক নবকৃষ্ণ দেব। বাংলা ইংরেজির পাশাপাশি অনেকগুলি বিদেশি ভাষা জানতেন। তাই ইংরেজদের ভাষা শেখানোর পাশাপাশি পর্তুগিজ, ডাচদের সঙ্গে ইংরেজদের ব্যবসায়িক লেনদেনে তিনি দোভাষীর কাজ করতেন। নবকৃষ্ণের ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও কথার গুণে ইংরেজদের বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রচুর লাভ হচ্ছিল। পারিশ্রমিকের পাশাপাশি প্রচুর বকশিসও পেয়েছেন নবকৃষ্ণ। হয়ে উঠেছেন লর্ড ক্লাইভের বড় ভরসার পাত্র। বাংলার তৎকালীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে ইংরেজের যুদ্ধে তাঁর একেবারে ভাগ্য খুলে গিয়েছিল। চার হাজার সওয়ারি, মহারাজ উপাধি, আরও অনেক সুবিধা তাঁকে দুহাত ভরে দিয়েছে ইংরেজ। আর তার চেয়েও বড় কথা, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কোশাগারের একটা বড় অংশ পড়েছে তাঁর ভাগে। কিন্তু ছোটবেলায় পিতৃহীন, সহায়-সম্বলহীন যুবক হঠাৎ ধনী হয়ে উঠলেও, অভিজাত সমাজে ঠাঁই পাবেন কী করে! এই দুর্গাপুজো সেই রাস্তাই খুলে দিল নবকৃষ্ণ দেবের কাছে।
এদিকে তখন তো শরৎকাল! তাতে কী! রাজার ইচ্ছেয় অকালবোধন হল দেবীর। ১৭৫৭ সালে, শোভাবাজারে তৈরি হল মহারাজা নবকৃষ্ণের রাজবাড়ি। ঠাকুর দক্ষিণমুখী হয়ে বসলেন দালানে, আর তাঁর সামনে বিশাল উঠোনের ওপারে উত্তরমুখী নাচঘরে, নামীদামি বাইজি/ নর্তকীদের আনিয়ে, হল ইংরেজ প্রভুদের মনোরঞ্জনের এলাহি আয়োজন। সন্ধিপুজোর শুরু ও শেষে যে কামান দাগা হল, শোনা যায় সেটিই নাকি পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয় এনে দিয়েছিল। ডাকের বাদ্যি, নাচঘরের ঘুঙুর, তোপধ্বনি ও ইংরেজদের উল্লাস সব মিলে নবকৃষ্ণের বাড়ির পুজো কিংবদন্তি হয়ে উঠল। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে যেতে লাগল এ বাড়ির পুজোর কথা। গোটা কলকাতায় এমন আর দ্বিতীয়টি নেই। পাশাপাশি এই নাচঘরের জলসাও কিংবদন্তি হয়ে উঠল। পুরনো কলকাতার ইতিহাস নিয়ে লেখা বহু বইতেই পাওয়া যায়, মা নাকি নাচ দেখতে আসেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে। তবে বাড়ির মহিলারা তখনও পর্দানশিন। তার ওপর নাটমন্দিরে ম্লেচ্ছ সাহেবদের আনাগোনা। সব মিলিয়ে পুজোর আয়োজনে বাড়ির মহিলাদের কোনও যোগদান ছিল না। চিকের আড়াল থেকে তাঁরা শুধু পুজো দেখতেন। এই রীতিই এখনও অনুসৃত হয়ে আসছে এ বাড়িতে। একচালা ঠাকুর, দেবী দুর্গার বাহন ঘোটকমুখী সাদা রঙের সিংহ। পুজো হয় মূলত বৈষ্ণব মতে। ভোগ হিসেবে মূলত শুকনো খাবার নিবেদন করা হয়, ডালের কচুরি, ডালের শিঙাড়া, তার মধ্যে অন্যতম। শোনা যায় এ বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কিছুদিন পুরোহিত হিসাবে কাজ করেছেন। দশমীতে প্রতিমা নিরঞ্জনের পর নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর চল ছিল। প্রবাদ অনুযায়ী এই পাখিই কৈলাসে গিয়ে মহাদেবকে মহামায়ার আগমনবার্তা দেবে। সেই রীতি মেনে এখনও দেবী প্রতিমার সাথের মাটির নীলকণ্ঠ পাখিও জলে দেওয়ার রীতি রয়েছে এ বাড়ির।
বর্তমানে সেই নাচঘর আর নেই। তবে ভেঙে পড়া ঠাকুরদালান, পুনরায় সারিয়ে, রং করে, এ বাড়ির হারানো ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আজ সেই বাড়ি ‘বড় তরফ’ বা বড়বাড়ি নামে পরিচিত। আর রাস্তার ঠিক উলটোদিকেই রয়েছে শোভাবাজার রাজবাড়ির ছোটতরফ। রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের বাড়ি। যিনি নবকৃষ্ণের নিজের সন্তান।
মহারাজা নবকৃষ্ণ প্রায় ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন। তারপর তাঁর ছেলে রাজকৃষ্ণের জন্ম হয়। তবে ততদিনে নবকৃষ্ণ দত্তক নিয়ে নিয়েছেন গোপীমোহনকে। বড় ছেলে গোপীমোহনই তাই আসল রাজবাড়ির উত্তরাধিকার পান। তাঁর পুত্র রাধাকান্ত দেব বাংলার নবজাগরণের যুগের এক বিশিষ্ট নেতা, যিনি নারীশিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর সময়েই এ বাড়িতে ছাগবলি বন্ধ হয়ে যায়। ছোট তরফ রাজকৃষ্ণের বাড়িতেও পুজো শুরু হয় একসময়। দুই বাড়ির পুজোর নিয়ম-নীতিও কিছু কিছু আলাদা হয়ে যায়। তবে বর্তমানে দুই বাড়িতেই নিয়ম-নীতি মেনেই পুজো হয়ে চলেছে।