গরম ভাতের টানে নয়, প্লাস্টিক কুড়োনোর নেশাতেই যেন রোজ স্কুলে আসতে শুরু করেছে ভারতের এই প্রত্যন্ত এলাকার বাচ্চারা। যে স্কুলে পড়তে টাকা লাগে না একটিও। বদলে জমা করতে হয় প্লাস্টিকের বোতল, আর সেটাই স্কুলের বেতন। কেন এমন অভিনব পথ নিয়েছে এই স্কুল? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
ভাঙাচোরা, চেপ্টে যাওয়া, থ্যাবড়ানো, যে কোনোরকম প্লাস্টিকের বোতল হলেই হল। কেবল ২৫টি করে প্লাস্টিকের বোতল জোগাড় করতে হবে প্রতি সপ্তাহে। তাহলেই স্কুলে পড়ার জন্য আর টাকা লাগবে না। হ্যাঁ, এটাই শর্ত এই স্কুলে পড়ার। এখানে বেতন হিসেবে টাকা লাগে না, বদলে জমা করতে হয় প্লাস্টিকের বোতল। এমন অভিনব বেতনের প্রথা মেনেই চলছে এই স্কুল। কিন্তু কী কারণ রয়েছে এহেন নিয়ম জারির পিছনে?
আরও শুনুন: শিবাজির হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার ছিল বাঘনখ, অবশেষে ভারতে ফিরছে সেই অস্ত্র
আসলে, প্লাস্টিক যেমন আমাদের পরিবেশের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর, তেমন এটা দিয়ে পরিবেশের জন্য ভালো কিছুও করা সম্ভব। আর তাই করে দেখিয়েছেন, পারমিতা শর্মা ও মাজিন মুখতার। এই দম্পতি ভারতের প্রত্যন্ত এলাকার দুটি বড় সমস্যা খুঁজে বের করেছেন, তা হল শিক্ষার বেহাল দশা আর প্লাস্টিক বর্জ্য। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, এই দুটো সমস্যাকে পাশাপাশি রেখে সমাধান খোঁজার। ফলে তার পরের কাজটা বোধহয় বেশ কিছুটা কঠিনই ছিল। কিন্তু শেষমেশ যে সমাধানটা উঠে এল, তা হল একে অন্যের পরিপূরক। এমন একটা রাস্তা, যাতে প্লাস্টিক আবর্জনা সাফাইও হয়ে যাবে আর শিক্ষার আলোও দেখবে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা। সব গুলিয়ে যাচ্ছে কি? তাহলে সেই সমাধানের রাস্তাটা খুলেই বলা যাক।
আরও শুনুন: দেখতে হুবহু পশু কিংবা পাখির মতো! এইসব ‘বহুরূপী’ গাছকে চেনেন কি?
প্লাস্টিকের প্যাকেট, বোতল ইত্যাদি জিনিস, আপ-সাইকেল বা রিসাইকেল করে, গাছ লাগানোর টব থেকে ইট, কাঠ, রাস্তা, টয়লেট কতরকম কিছুই না তৈরি করা যায়। এটা আমরা প্রায় সকলেই জানি। কিন্তু এই গোটা কর্মকাণ্ডে প্রয়োজন লোকবলের। এমন কাজ করতে ইচ্ছুক অনেক লোক মিলবে কোথায়? কিন্তু, সেই কাজটাই যদি ছাত্রদের দিয়ে সামলে ফেলা যায়? তেমনটাই ভেবেছিলেন এই দম্পতি। তাই, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্ষর ফাউন্ডেশানের তরফে, অসমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে তোলা হয় এমন একটা স্কুল যেখানে নিজেদের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাতে পারে পড়ুয়ারা। উপরন্তু রয়েছে বাড়তি রোজগারের উপায়ও। কীরকম? প্রথমত ছাত্রছাত্রীরা পাশ করে উঁচু ক্লাসে উঠে যাওয়ার পর, সেই ক্লাসের ভাল ও যোগ্য ছাত্রছাত্রীদের ওপর দায়িত্ব পড়ে, নিচু ক্লাসের পড়ুয়াদের, পড়াশোনা বা গার্ডেনিং-এর কাজ শেখানো, আর এর মাধ্যমেই তারা রোজগারও করতে পারে। আর প্লাস্টিক বোতল জমা দেওয়ার পরিবর্তেও ছাত্রছাত্রীদের টাকা দেওয়া হয়। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম্য জীবনে অভ্যস্ত বাবা-মাদের, অনেক সময়ই বাচ্চাদের থেকে সেই টাকা নিয়ে নিজেদের নেশার সামগ্রী কিনতে দেখা গেছে। এটা রুখতে স্কুল একটা নিজস্ব ব্যাঙ্ক তৈরি করেছে। প্লাস্টিক বোতল জমা দেওয়ার পরিবর্তে সেই ব্যাঙ্কে পয়েন্টস জমা রাখতে পারে খুদে পড়ুয়ারা। যা নিজেদের পছন্দ ও প্রয়োজনমতো খরচ করতে পারবে। সপ্তাহে ২৫টির বেশি বোতলে, তারা ব্যাঙ্কে জমায় ভবিষ্যতের স্বপ্ন। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নই তাই পেয়ে বসেছে এই পড়ুয়াদের। নতুন কিছু তৈরির নেশা। ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে, আবার ব্যবহারের মত কিছু করার নেশা। আর এই শেখার আনন্দেই এই স্কুল গড়েছে আরও এক রেকর্ড। এখানকার ড্রপ আউট ছাত্রের সংখ্যা ০%। অর্থাৎ কোনও ছাত্রই এখানে আসার পর, আর দলছুট হতে পারেনি। আর এইভাবেই, শিক্ষার আলো ছড়ানোর পাশাপাশি বর্জ্যও দূর করতে চেয়ে, আক্ষরিক অর্থেই এক নির্মল পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে চলেছে এই স্কুল।