শুরুতে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও ,শিবদাস ভাদুড়ি আর অভিলাষ ঘোষের গোলে জয় ছিনিয়ে এনেছিল সেই ‘অমর একাদশ’। নিছক একটি ফুটবল ম্যাচ যে স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন অধ্যায় লিখবে, স্বদেশপ্রেমের এমন এক জাগরণ ঘটাবে তা সেদিন কল্পনাও করতে পারেনি ওই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। গোলের হিসাব পেরোলে যা থেকে যায়, তা হল সেই ম্যাচের ঐতিহাসিক তাৎপর্য।
সে ছিল এক মরণপণ লড়াইয়ের দিন। সে ছিল অধিকার অর্জনের দিন। সে ছিল আত্মসম্মান ছিনিয়ে নেওয়া লড়াইয়ের দিন। ২৯ জুলাই, ১৯১১। ১০৯ বছর আগের সেই দিনটিতে আক্ষরিক ভাবে কোনও গুলি-বারুদের যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু যা হয়েছিল তা গুলি-বারুদের থেকে কম কিছু নয়। সেদিন গোলের হিসাবে লেখা হয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সোনালি অধ্যায়। বুট-পরা গোরাদের ঔদ্ধত্য যেদিন নতজানু হয়েছিল খালি-পা অমর একাদশের দাঁতে-দাঁত-চেপা লড়াইয়ের সামনে। লড়াইয়ের যে ইতিবৃত্ত এখনও প্রাণিত করে ভারতবাসীকে।
আরও শুনুন: মাহি পুজো! ৭৭ ফুটের কাট-আউট, দুধ ঢেলে ফিল্মি কায়দায় জন্মদিন উদযাপন ভক্তদের
খাতায়-কলমে বলতে গেলে, শতাধিক বছর আগে সেদিন একটি ম্যাচ হয়েছিল। যার এক পক্ষে ছিল ইস্ট ইয়র্কসায়ার রেজিমেন্ট, অন্যদিকে মোহনবাগান। নব্বই মিনিটের একটা ম্যাচ সেদিন আচমকাই বদলে গিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে তখন উত্তাল হয়েছে স্বদেশী আন্দোলন। দিকে দিকে ঔপনিবেশিক শক্তিকে উচ্ছেদের সংগ্রাম হয়েছে তীব্রতর। ঠিক সেই প্রেক্ষিতেই চলে এসেছিল এই ম্যাচ। যার একদিকে যেহেতু ব্রিটিশ, অবধারিত ভাবেই অন্যদিকের এগারোজন হয়ে উঠলেন স্বদেশী সৈনিক। অর্থাৎ একটি ম্যাচ মাহাত্ম্য পেয়ে গেল স্বাধীনতা সংগ্রামের। আইএফএ শিল্ড ফাইনালকে কেন্দ্র করেই ব্রিটিশদের সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য তখন মুখিয়ে দেশবাসীকে। কিন্তু প্রতিকূলতা তো কম নয়। ধারে-ভারে অনেকটাই পিছিয়ে স্বদেশী দল। তার উপর আবার ব্রিটিশদের সাজানো মঞ্চেই তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু সত্যি বলতে সেদিন এগারো অশ্বারোহী কেবল মাঠে নামেননি। বরং নেমেছিল অভিভক্ত বাংলা। যে বাংলাকে খণ্ডিত করতে উদ্যোগী ছিল ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী তরবারী। বাংলার প্রাণ সেদিন কেঁদেছিল। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সাধ্যমতো। তবু শেষরক্ষা হবে কি-না তা বোঝা যাচ্ছিল না। ইতিহাসের সেই মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া মুহূর্তেই দাঁড়িয়েছিলেন শিবদাস ভাদুড়ি, অভিলাষ ঘোষরা। সারা বাংলার অভিলাষ, হারুক ব্রিটিশরা। সারা বাংলার আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে তাঁদের উপর। একটাই কামনা, হেরে যেন মাঠ না ছাড়ে ভারতীয় সিঙ্ঘের দল। তবু মাঠের লড়াই তো মাঠেই করতে হয়। শিবদাসরা জানতে তাঁদের চোয়াল-চাপা-জেদকে বদলে দিতে হবে সংগ্রামের আগুনে। পা খালি হোক, মন তো বারুদে ঠাসা। সেই বারুদে যেন বিস্ফোরণ হয় ম্যাচে। সেই বিস্ফোরণে যেন ছিন্নভিন্ন হয় ব্রিটিশ-ঔদ্ধত্য। অতএব খালি পায়ে সেদিন যে ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন তাঁরা, তা যেন হয়ে উঠেছিল ইতিহাসেরই ভাষ্য। ঔপনিবেশিক শক্তি বনাম পরাধীন জাতিত আত্মসম্ভ্রম আদায়ের লড়াই।
আরও শুনুন: মহেন্দ্র সিং ধোনি: প্রহরশেষের আলোয় দেখা ভারতীয় ক্রিকেটের অমোঘ সর্বনাশ
এল ২৯ জুলাই। সেদিন মোহনবাগানের হয়ে মাঠে নামলেন স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ একদল যোদ্ধা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁরা অকুতোভয়। লড়াই হল, খালি পা বনাম বুটের। লড়াই হল ঔদ্ধত্য বনাম স্বদেশের মুক্তির স্বপ্নের। অত্যাচারী শক্তি বনাম অত্যাচারিতের প্রতিবাদের। সে ম্যাচের ফলাফল আমাদের সকলেরই জানা। শুরুতে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও ,শিবদাস ভাদুড়ি আর অভিলাষ ঘোষের গোলে জয় ছিনিয়ে এনেছিল সেই ‘অমর একাদশ’। নিছক একটি ফুটবল ম্যাচ যে স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন অধ্যায় লিখবে, স্বদেশপ্রেমের এমন এক জাগরণ ঘটাবে তা সেদিন কল্পনাও করতে পারেনি ওই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। গোলের হিসাব পেরোলে যা থেকে যায়, তা হল সেই ম্যাচের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব নাকচ এবং কলকাতা থেকে রাজধানী সরানোর প্রেক্ষাপট ছিল এই ম্যাচের দৌলতে সৃষ্টি হওয়া স্বদেশি জাগরণ। ব্রিটিশ বিরোধী এই লড়াই এবং ব্রিটিশদের ওই পরাজয় সব সংগ্রামীদের এক সুতোয় গেঁথেছিল। স্বাধীনতার স্বপ্নালু আবেগের বিস্ফোরণের সেদিন সাক্ষী থেকেছিল গোটা দেশ।
আরও শুনুন: মেসির হয়ে প্রথমবার মুখ খুললেন এমবাপে… কেন এই ভোলবদল? প্রশ্ন ফুটবলপ্রেমীদের
১০৯ বছর পরেও , সেদিনের সেই লড়াই আজও একই ভাবে প্রাসঙ্গিক। কেননা এই ইতিহাস বলে, লড়াই বিফল হয় না। তা যে কোনও রূপেই দেখা দিতে পারে, যে কোনো রূপ ধারণ করতে পারে। এই লড়াইয়ের চালিকাশক্তি মানুষের আবেগ,মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্ন যে কবে কোথায় কখন বিস্ফোরণ ঘটাবে, তা শাসক বুঝে উঠতে পারে না। সেদিনও পারেনি, আজও পারে না।