পুরাণে তাঁর মাহাত্ম্য বাখ্যা সেই অর্থে নেই। তবে মঙ্গলকাব্যে মনসা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। বাংলায় সামগ্রিকভাবে তাঁর পুজো শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই, গ্রামবাংলা তাঁকে দেবী হিসেবে বরণ করে নেয়। সেই দেবী মনসাকে পুজো করলে তুষ্ট হন স্বয়ং মহাদেব। নাগপঞ্চমী দেবীর অন্যতম প্রিয় তিথি। এইদিন কোন নিয়ম পালন করলে দেবী তুষ্ট হন? আসুন শুনে নিই।
শ্রাবণমাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী। সারা দেশ এই বিশেষ দিনটিকে নাগপঞ্চমী হিসেবে পালন করেন। মূলত বাংলার একটি অতি প্রচলিত ও জনপ্রিয় উৎসব। তবে নাগপঞ্চমী কেরল-সহ ভারতের বেশ কিছু জায়গায় সাড়ম্বরে পালিত হয়। সবক্ষেত্রেই রয়েছে নাগ দেবীর মন্দির। তবে বাংলার নাগপঞ্চমী ব্রতের আবির্ভাব কাহিনি খানিক অন্যরকম।
আরও শুনুন: শুধু অম্বুবাচী নয়, মা কামাখ্যার বিয়ে উপলক্ষেও সেজে ওঠে নীলাচল পর্বতের মন্দির
বাংলায় মনসামঙ্গল কাব্য মনসার দেবীত্ব লাভের সেই কাহিনি আমাদের শোনায়। সেখানে উল্লেখ রয়েছে চাঁদ সদাগরের কথা। কথিত আছে তাঁর হাতে পুজো পেয়েই বাংলায় মনসার পুজো শুরু হয়েছিল। নিজের জেদে লোকদেবী মনসাকে পুজো করতে অস্বীকার করেছিলেন ধনী ব্যবসায়ী চাঁদ সদাগর। প্রতিশোধ নিতে মনসা তাঁর সমস্ত ব্যবসায়ী নৌকা সাগরে ভাসিয়ে দেন। সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় তাঁর ছয় পুত্রের। হাজার অনুরোধ সত্ত্বেও মনসার পুজো করবেন না বলেই অটল ছিলেন চাঁদ। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁর জেদ ভাঙতে বাধ্য হয়। সপ্তম পুত্র লখিন্দরের পুত্রের পর তাঁর পুত্রবধূ বেহুলা স্বর্গে গিয়ে স্বামীর প্রাণ নিয়ে আসে। সেক্ষেত্রেই শর্ত ছিল চাঁদ যেন মনসার পুজো করেন। এরপর আর উপেক্ষা করতে পারেননি চাঁদ সদাগর। বাঁ হাতে মনসার উদ্দেশে ফুল ছুড়ে দেন তিনি। এর থেকেই বাংলায় দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান মনসা। তবে বাংলায় বিশেষ রিতিতে মনসার পুজোর প্রচলন ছিল বহু আগে থেকেই। সেই নিয়মেই এখনও মনসা পুজোর আয়োজন হয়। মূলত এক বিশেষ গাছকে পুজো করা হয় মনসা রূপে। তবে নাগপঞ্চমীর দিন স্রেফ দেবি মনসার পুজো করাই যথেষ্ট নয়। পুজো করতে হয় অষ্টনাগেরও। এছাড়া সমস্ত সর্পকুলের উদ্দেশে ভোগ নিবেদনের বিশেষ নিয়মও রয়েছে। গ্রামবাংলায় এইদিন দুধ-কলা প্রধান ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে বিভিন্ন মরশুমি ফল ও মিষ্টি দেওয়া যেতে পারে। নিয়ম বলতে বিশেষ কিছু নেই। তবে মনসা পুজোয় ধূপ ধুনো জ্বালানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
আরও শুনুন: মনসাপুজোর অন্যতম তিথি, দশহরায় কোন নিয়ম পালনে বিশেষ ফল মেলে?
যদিও সারা দেশে নাগপঞ্চমীর দিন আরও অনেক ধরনের নিয়ম পালনের প্রথা রয়েছে। এক্ষেত্রে নাগপঞ্চমীর ইতিহাসও খানিক অন্যরকম। শ্রীকৃষ্ণের এক লীলাকথন বর্ণিত আছে নাগপঞ্চমীর ইতিহাস হিসাবে। এছাড়া নাগপঞ্চমীর দিনে বিশেষ এক প্রথার প্রচলন রয়েছে মহারাষ্ট্রে। সেখানে সর্পদেবতাকে পূজা নিবেদন করেন ভক্তরা। তবে এই পূজার বিশেষত্ব হল, মূর্তি নয়, জীবন্ত সাপকেই পূজা করা হয়। অন্যদিকে কেরলের নাগ দেবতার মন্দিরে দলে দলে ভক্তরা আসেন পুজো দিতে। প্রত্যেকেরই প্রার্থনা পরিবারের কারোর যেন সর্প দংশনে মৃত্যু না হয়। শুধু তাই নয়, সর্পদেবীর সঙ্গে স্বয়ং লক্ষ্মীর তুলনাও করেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে তাঁকে তুষ্ট করলে ধনাগমও অবসম্ভাবী। দক্ষিণ ভারতের কিছু জায়গায় সর্পদেবীকে প্রচুর গয়না পরিয়ে দেবী লক্ষ্মী রূপেই আরাধনা করা হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস এভাবেই তাঁদের অর্থভাগ্য ফিরবে। তবে বাংলায় দেবীকে যে চিরাচরিত রীতি মেনে পুজো করা হয় তাই যথেষ্ট। দেবী মাত্রেই মহামায়ার অংশ। সেক্ষেত্রে দেবী মনসার সঙ্গে লক্ষ্মীর তুলনা করায় বহু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বিশেষ আপত্তি তোলেন না। ভক্তিভরে দেবীকে স্মরণ করলে যে কোনও বিপদ থেকে মুক্তি এবং সুদৃঢ় ভবিষ্যৎ লাভ সম্ভব।