বিরিয়ানি ভালবাসে না, এমন মানুষের দেখা মেলা ভার। রাজা-মহারাজা থেকে আমজনতা, সবার প্লেটের প্রতি তার সমান দৃষ্টি। কিন্তু যতই রাজকীয় খাবার হোক না কেন, এহেন বিরিয়ানির জন্ম কিন্তু মোটেও তেমন অভিজাত ঘরে নয়। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
যুদ্ধ চলছে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। চারদিকে রক্তের গন্ধ। অস্ত্রের ঝনঝনানি। বারুদের গন্ধে ভারি হয়ে আছে বাতাস। ইতিউতি হয়তো ছড়িয়ে আছে আহত বা নিহত মানুষ কিংবা পশুও। খবরের কাগজেই হোক বা রুপোলি পর্দায়, যুদ্ধক্ষেত্রের এহেন বীভৎস ছবি কে না দেখেছে! আচ্ছা বলুন তো, এমন ছবি দেখলে কি আদৌ মনে কোনও রোমান্টিক ভাবনা জেগে ওঠা সম্ভব? অথচ যে খাবারটির নাম শুনলেও আপনি আপ্লুত হয়ে পড়েন, সেই বিরিয়ানির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে এই যুদ্ধক্ষেত্রই। আজকের দিনের এই জনপ্রিয় খাবারটির জন্ম হয়েছিল এখান থেকেই।
আরও শুনুন: Biryani: বাঙালির বিরিয়ানিতে আলুর ঠাঁই হল কীভাবে?
বিরিয়ানি নিয়ে এখন যতই হইচই চলুক না কেন, এই খাবারটি মোটেও তেমন অর্বাচীন নয়। বরং অনেকদিন আগে থেকেই চল ছিল এর। ভাতের সঙ্গে মাংস রান্নার প্রথম উদাহরণ পাওয়া যায় তামিল সঙ্গম সাহিত্যে। সেটা দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের কথা। ‘অন্ন সুরু’ নামের এই খাবারটি যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদলকে খেতে দেওয়া হত। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে রান্না করার সুবিধেটাই এখানে প্রধান ছিল, মশলাপাতি দিয়ে রান্নাটিকে তেমন সুস্বাদু করার চেষ্টা হয়নি।
এরপর ধরুন ১৩৯৮ সালের কথা। দিল্লি আক্রমণ করতে আসছেন দুর্ধর্ষ মুঘল দস্যু তৈমুর লং। বলা হয়, তাঁর সেনাবাহিনীর সঙ্গে নাকি ছিল মাটির বড় বড় পাত্র। যেখানে তাঁর সেনাদল ঘাঁটি গাড়ত, সেখানে কাটা হত বড় বড় উনুন। আর সেই উনুনে চাপিয়ে দেওয়া হত ভাত, নুন আর গোস্ত। সারা দিন হালকা আঁচে রান্না হতে থাকত সেই খাবার। আজকে যে দম বিরিয়ানি খেতে সকলে ভিড় জমান, সেই দমের প্রচলন এখান থেকেই শুরু বলে মনে করা হয়।
আরও শুনুন: Samosa: বাঙালির অতি প্রিয় শিঙাড়া নাকি আদতে ‘ভারতীয়’ই নয়!
যদি আরও খানিক এগিয়ে আসা যায়, পৌঁছনো যাবে মুঘল আমলে। দিল্লির মসনদে তখন শাহজাহান। ১৬১২ সালে মমতাজকে বিয়ে করেছেন সম্রাট। আর তাজমহল ছাড়াও বিরিয়ানির জন্য মনে রাখা যায় এই বেগমকে। শোনা যায়, মমতাজ নাকি একবার মুঘল সেনাদের ছাউনি দেখতে যান। সেখানে সৈন্যদের রুগ্ন স্বাস্থ্য দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। সেনারা দুর্বল হলে দেশকে রক্ষা করবে কে? তাই তিনি তলব করলেন মুঘল খানসামাদের। বেগমের নির্দেশে চাল, মাংস আর মশলা একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হল এক নতুন খাবার। যা ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠল মুঘল শাহি হেঁশেলেও।
বিরিয়ানির মাহাত্ম্য কেবল এর স্বাদে গন্ধেই নয়, এর মতো ভাল ওয়ান পট মিল মেলাও কিন্তু দুষ্কর। পাশাপাশি, রেস্তরাঁয় খাবার খেতে গেলেও দেখা যায়, অন্যান্য খাবারের তুলনায় এক প্লেট বিরিয়ানির পরিমাণ সাধারণত বেশিই হয়। দাম যদি বাড়েও, পরিমাণ কিন্তু তেমন কমে না। মনে করা হয়, এর নেপথ্যেও রয়েছে বিরিয়ানির জন্মকাহিনিই। যুদ্ধক্ষেত্রে রান্না খাবার তো আর পর দিন পর্যন্ত রাখা যাবে না। এদিকে যতই মেপে রান্না হোক না কেন, যুদ্ধ করতে যতজন যাবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দিনের শেষে তারা সবাই ফিরবে না। ফলে অবশিষ্ট লোকদের ভাগ্যেই জুটত বেশি পরিমাণে খাবার। এই অনিশ্চয়তাই কি বিরিয়ানির স্বাদ বাড়িয়ে দিত আরও বেশি করে? তার উত্তর বোধহয় দিতে পারবে না ইতিহাসও।