তিনি গৃহী আবার সন্ন্যাসীও। একাধারে তুখোড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবার ধন্বন্তরি চিকিৎসকও। প্রশাসনিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যিনি হয়ে উঠেছেন পশ্চিমবঙ্গের রূপকার, তিনিই আবার নিয়ম করে আবৃত্তি করতেন রবি ঠাকুরের পঙক্তি। আবার এত কাজের ভিতরও বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাঁর সকৌতুক মন। কর্মযোগী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের জীবনের অজানা গল্প শোনালেন অরিঞ্জয় বোস।
তিনি কর্মযোগী। একাধারে তুখোড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবার ধন্বন্তরি চিকিৎসকও। প্রশাসনিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যিনি হয়ে উঠেছেন পশ্চিমবঙ্গের রূপকার, তিনিই আবার নিয়ম করে আবৃত্তি করতেন রবি ঠাকুরের পঙক্তি। নির্বাচনের ব্যস্ততার ভিতরও নিকটজনের ব্যক্তিগত অভিযোগ মন দিয়ে শুনেছেন, যথাস্থানে তা জানিয়ে সমাধানের ব্যবস্থাও করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথে মতো ব্যক্তিত্বের চিকিৎসাভারও যেমন নিয়েছেন, তেমনই করে গিয়েছেন গরিব-দুঃখীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা। না, সময় নিয়ে কোনোদিন টানাটানি পড়েনি তাঁর। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন এই মন্ত্রে যে, যে কাজ কাল করার কথা তা আজই শেষ করে ফেলা উচিত। আসলে বিধান রায় মানেই একজন স্বপ্ন দেখা মানুষ। আর এই কর্মমুখর জীবনের অন্তরালে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাঁর সকৌতুক মনটিকেও।
আরও শুনুন: আদর নয়, তাড়ানো হল জামাইকে! মজায় জমজমাট প্রথম সবাক বাংলা ছবি ‘জামাইষষ্ঠী’
বিধান রায়ের এই কর্মমুখরতার আদর্শ নিয়ে আমাদের আলোচনা কিঞ্চিৎ কমই। বরং তাঁর তথাকথিত কাল্পনিক ‘প্রেম’, কল্যাণী নগরীর নামকরণ ইত্যাদি নিয়েই চর্চা বেশি। জনশ্রুতি এই যে, প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক ডাঃ নীলরতন সরকারের কন্যাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন তিনি। যে স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলেই প্রেমিকার নামে নগরীর নাম রেখেছিলেন কল্যাণী। সে জনশ্রুতির উৎস অধরা। তবে বাস্তবে দেখা গিয়েছে, এর কোনও ভিত্তিই নেই। কেননা নীলরতন সরকারের কল্যাণী নামে কোনও কন্যাই ছিল না। তাই সে আলোচনা থাক। বরং বিধান রায় তাঁর সারা জীবনে এক গৃহী সন্ন্যাসী হয়েই থেকেছেন।
এ বিষয়ে তাঁর প্রেরণা ছিলেন তাঁর মা-বাবা। তাঁরাও এরকমই গৃহী সন্ন্যাসীর আদর্শেই অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীকালে বিধান রায় স্বয়ং সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। মা-বাবার মতোই সময়ের অপব্যবহার তাঁর পছন্দ ছিল না। বরং প্রাত্যহিক দায়িত্ব-কর্তব্য অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করতেন। প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন যখন, তখনও তাই তাঁকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখা গিয়েছে। ফাইলে চোখ রেখেই নানা কথা শুনে নিতেন তিনি। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করতেন। রবি ঠাকুরের একটি ধর্ম-সঙ্গীতই ছিল তাঁর মন্ত্র। প্রতিদিন সকালে তিনি সেই পঙক্তিই আবৃত্তি করে বলতেন,
প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর, হে ভুবনেশ্বর,দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
…
তোমার বিচিত্র এ ভবসংসারে কর্মপারাবারপারে হে,
নিখিলজগৎজনের মাঝারে দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
আরও শুনুন: ধর্ম বদল হয়নি পাত্রীর, ১০০ বছর আগে বিয়েতেও ‘বিদ্রোহী’ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম
অর্থাৎ মানুষের সেবাই ছিল তাঁর কাছে ঈশ্বরসেবা। ‘জীবজ্ঞানে শিবসেবা’র মহামন্ত্রটিরই যেন মূর্ত রূপ যেনই ডাঃ রায়ের জীবন। তাই শত ব্যস্ততাতেও চিকিৎসাকে কোনওদিন দূরে সরিয়ে রাখেননি। আসলে মানবসেবার যে ব্রত তিনি নিয়েছিলেন, তার এক অক্ষে যেমন রাজনীতি, তেমনই অন্য অক্ষে ছিল চিকিৎসা। ধন্বন্তরি ডাক্তার রোগ নির্ণয়ে ছিলেন নির্ভুল। আর কোনক্রমে নিজের আবেদনটুকু নিয়ে তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারলেই হল। ডাঃ রায়ের কাছে কেউ নিবেদন নিয়ে গিয়েছেন, অথচ খালি হাতে ফিরতে হয়েছে এমনটি হয়নি কখনও। তাঁর এক কলম লেখাতেই সমস্যার সমাধান। সে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া হোক কিংবা বই কিনতে না পারা। বিধানবাবুর বিধান খণ্ডাতে পারতেন না কেউই। মা-বাবার নামে কত পুড়ুয়াকে যে বই কিনে দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। বর্তমানে যখন রাজনীতিতে পারস্পরিক সৌজন্যের বেজায় টানাটানি, তখন বিধান রায়ের আদর্শ অনেকেরই পাথেয় হতে পারে। পীড়িত রাজনৈতিক কর্মীদের চিকিৎসায় ফি নিতেন না কখনও। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতিও তাঁর ছিল অসীম শ্রদ্ধা। আর কী রাজনীতি, কী চিকিৎসা ক্ষেত্র- তাঁর কর্তব্যজ্ঞানের নমুনা ছিল উদাহরণযোগ্য। এ নিয়ে বহু ঘটনাই বলা যায়, আপাতত একটা ঘটনাই উল্লেখ করা যাক। সে সময় বিলেত থেকে ফিরে তিনি তাঁর অগ্রজের সঙ্গে ল্যান্সডাউন রোডের একটি বাড়িতে থাকতেন। একদিন গভীর রাতে সেই ঘরে তাঁকে দেখা গেল না। সকলেই চিন্তিত হয়ে উঠলেন। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাঁর দেখা পাওয়া গেল। সকলেই জানতে চাইলেন, এত রাতে, তিনি কোথায় গিয়েছিলেন? উত্তরে তিনি জানালেন, গিয়েছিলেন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে এক রোগীর বাড়ি। তাঁকে দিনের বেলাতেই দেখে এসেছিলেন। ওষুধের মাত্রাও ঠিক করে দিয়েছিলেন। মাত্রার একটু হেরফের হলে বিপদ বাড়তে পারে। রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে সে কথা মনে পড়ে। সন্দেহ হয়, মাত্রার নির্দেশ ঠিকমতো দিয়েছিলেন। মনে হওয়া মাত্র পায়ে হেঁটে চলে গিয়েছিলেন রোগীর বাড়িতে। গিয়ে দেখেন, ভুল কিছু হয়নি। নির্দেশ ঠিকই ছিল। মাইল ছয়েক রাস্তা সেই রাতে পায়ে হেঁটেই গিয়েছিলেন বিলেতফেরত চিকিৎসক, কারণ ওই কর্তব্যবোধ।
এই কর্মযোগীর কঠিন আবরণের ভিতরেও প্রবাহিত ছিল কৌতুক ধারা। সকৌতুক মনের ভিতরই তো প্রাণের স্ফূরণ। কতিপয় মানুষই ডাঃ রায়ের সেই দিকটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সাধারণত তাঁকে কড়া, গম্ভীর প্রকৃতির বলেই মনে হত। তবে চূড়ান্ত রাজনৈতিক সমালোচনাও তিনি সহজ ভাবেই নিতে পারতেন। কথাও বলতেন হেসে হেসেই। তাই তাঁর হুকুমের মধ্যেও মিশে থাকত অনুরোধের সুর। ভর্ৎসনাও শোনাত আদরের মতোই। আসলে কঠিন প্রকৃতির মানুষটার ভিতরে যে একজন অতীব কোমল মনের মানুষের বাসা, তা নিকটজনেরা জানতেন। কোনও এক ব্যাপারে মহিলারা তাঁকে’শালা’বলেছিলেন। কথাটা মনে রেখেছিলেন স্বয়ং বিধান রায়। একদিন কথা প্রসঙ্গে আধুনিক মহিলাদের কথা এলে উচ্চহাস্য করে বলেছিলেন, “মেয়েরা সত্যিই জেগেছে হে! আমাকে একজন সেদিন ‘শালা’ বলেছিল!”
এই হলেন বিধান রায়। কর্তব্যে অবিচল নিষ্ঠা। পছন্দ করতেন না সময়ের অপব্যবহার। কাজের মধ্য দিয়ে মানবকল্যাণই ছিল তাঁর আজীবনের ব্রত। গৃহী হয়য়েও যিনি আদতে সন্ন্যাসী। কর্মযোগী সন্ন্যাসীর যে সনাতন ধারা ভারতবর্ষের মাটিতে আবহমান কাল থেকেই প্রবহমান, ডাঃ রায় যেন সে-ধারারই আধুনিক কাণ্ডারি। গান্ধীজির মতো তিনি হয়তো বলে যাননি, তবে উত্তরকাল জানে, কোনও কোনও মানুষের জীবনই হয়ে উঠতে তাঁর বাণী। সেই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বদেরই একজন ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়।