কথায় বলে, ছোটমুখে বড় কথা নাকি মানায় না! কিন্তু আমূল গার্লের দিকে তাকিয়ে দেখুন। একরত্তি মেয়ে দিব্যি দেশের তাবড় ঘটনা নিয়ে বড় বড় কথা বলে ফেলছে অনায়াসে। আর তার সেই ছোট্ট মুখে মর্ম-বেঁধে কথার ভিতর লুকিয়ে থাকা হাসির বাণটি এসে বিঁধছে দেশবাসীর অন্তরে। বালিকাটি যাঁর ভাবনার ঔরসে জাত, সেই সিলভেস্টার ডা’কুনহা সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। তবে তাঁর আমূল-বালিকা আমূল নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে ভারতীয় বিজ্ঞাপনের জগৎ, এমনকী দেশবাসীর চিন্তার ভুবনও। অমর স্রষ্টা আর তাঁর সৃষ্টির স্মৃতিচারণায় অরিঞ্জয় বোস।
একরত্তি বালিকা! ফোলা-ফোলা গোলগাল লাল-লাল গাল, মাথায় ‘বো’ বাঁধা পনি টেল আর পরনে লালের ওপর সাদা পোলকা ডটের ফ্রক। এমন ছোট্ট মেয়ের মুখে কী আর শোনা যাবে! বড়জোর ছড়া কিংবা ছোটদের মনভোলানো দু-একটা শিশুপাঠ্য কবিতা কিংবা গান। কিন্তু না, ছোটদের সম্পর্কে আমাদের এই ধারণা সর্বাংশে সত্যি নয়। বরং ছোটরাই অনায়াসে বলে ফেলতে পারে, সেইসব কথা, যা বড়রা বলতে দুবার করে ভাবেন, আর বেশিরভাগ সময়ে বলেই উঠতে পারেন না। মনে আছে, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় সেই ছোট্ট ছেলেটিই বলে উঠেছিল, রাজা তোর কাপড় কোথায়! কিংবা অন্নদাশঙ্কর রায়ের খুকুই বলে উঠতে পারে, তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো! সিলভেস্টার ডা’কুনহার আমূল-বালিকা আসলে এই ছোটদেরই সার্থক প্রতিনিধি।
যে ছোট আসলে ছোটটি নয়। বরং ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি বলার সৎসাহস যার থাকে। যা বড়দের থাকা উচিত, কিন্তু থাকে না। অর্থাৎ এই ছোট আসলে বড়দেরই অপ্রকাশিত বা আড়ালে থাকা একটি রূপ। আর তাই অতীতের জরুরি অবস্থা থেকে বর্তমানে ‘মহাগঠবন্ধন’, জয়ললিতার গ্রেপ্তারি থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতায় আসা, সবকিছু নিয়েই কথা বলেছে সে। বলতে গেলে, গত ৫০ বছর ধরে ভারতবর্ষের সমস্ত ঘটনাকে যে ‘আটার্লি বাটার্লি’র চোখ দিয়ে দেখেছেন সে এই ‘আমূল গার্ল।’ ভারতীয় চিন্তনে যার ছবি বঁড়শির মতো আটকে আছে। ‘আমূল’-এর সাফল্যের অন্যতম কাণ্ডারিও এই বালিকাই।
আরও শুনুন: উস্তাদ বড়ে গোলাম আলির ‘হরি ওম্’, ভীমসেন যোশির আল্লা-উপাসনা… সংগীতে মুছে যায় ধর্মের বিভেদ
‘আমূল’স ইন্ডিয়া’ বইতে যা উল্লেখ, তাতে দেখা যাচ্ছে ১৯৬৬-৬৭ সাল নাগাদ সিলভেস্টার ডা’কুনহা ও ইউস্টেস ফার্নান্দেজ এই আমূল গার্লের সৃষ্টি করেন। একজনের ভাবনা, অন্যজনের রূপায়ণ। জন্ম নিয়েছিল আমূল বালিকা। ভাবনার আদিতে ছিল একটা গুড়গুড়ে মেয়ের কথা যে অনায়াসে ভারতীয় নাগরিকের ঘর, রান্নাঘর ছুঁয়ে অন্তরের অন্দরমহলে জায়গা করে নিতে পারে। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে বিপণনের একটা যোগাযোগ তো থেকেই যায়। তাই আমূলের প্রোডাক্টকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ব্র্যান্ডের নামটিকে কানে কানে পৌঁছে দেওয়াই ছিল বালিকার কাজ। আমূলের প্রথম বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছিল আমূল-গার্ল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বলছেন ‘গিভ আস দিস ডে আওয়ার ডেইলি ব্রেড: উইথ আমূল বাটার’। বাংলায় যার অর্থ হয়,’ হে ভগবান! আজকের দিনে আমাদের পেটের খাবার জুগিয়ো, আর সঙ্গে যেন আমূলের মাখন থাকে’! খেয়াল করে দেখুন, এই দুধে-ভাতে থাকার চিন্তা তো সেই ঈশ্বরী পাটনী থেকে শুরু করে যুগে যুগে সকল মা-বাবারই। অর্থাৎ ছোট্ট মেয়েটি যা বলছে তা আসলে বড়দের মনের কথাটিই। খাবারের সঙ্গে যদি মাখনও জুটে যায় তবে মন্দ কী! শুরু হল আমূল-বালিকার পথচলা।
কিছুদিনের মধ্যে ডা’কুনহা ভাবেন যে খালি খাবারের জিনিস এবং আমূলের তৈরি জিনিসের প্রচার নয়, বড় খবর ও নানান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়েও আমূল-গার্ল কথা বলবে। মূলত এই মোড় থেকে অন্য মাত্রা পেল আমূল-বালিকা। সে কেবল একটি সংস্থার বিজ্ঞাপনী ম্যাসকট হয়ে রইল না। বরং ভারতবর্ষের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পটবদলের ধারাভাষ্যকারের পর্যায়ে উন্নীত হল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার ডাক, বোফর্স কেলেঙ্কারি, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার গ্রেপ্তার হওয়া, সবেতেই আমূল-গার্ল এক এবং অদ্বিতীয় ভাবে নিজের কথাটি বলেছে অকুতোভয়ে।
রাজ্যভিত্তিতে তার বক্তব্যও বদলে বদলে গিয়েছে। বাম আমলে যখন বঙ্গে নিয়মিত বনধ হত, আমূল বিজ্ঞাপন করেছিল, আমূল গার্ল বলছে, ‘আমূল বাটার ছাড়া রুটি- চলবে না, চলবে না!’ এই ভাবনার তারিফ করেছিল বিরোধীরাও। লোকসভা নির্বাচন থেকে বিধানসভা নির্বাচন, সর্বত্রই সে বিরাজমান। দেশের রাজনীতিতে বিরোধী জোটের ‘মহাগঠবন্ধন’কে ‘মাসকা-গঠবন্ধন’ বলে টিপ্পনি কেটেছিল সে। নেতা-মন্ত্রীদের ছবিও ওই আমূল গার্লের আকারে এঁকে বাজিমাত করেছিল ‘আমূল’। নরেন্দ্র মোদী থেকে মমতা বন্দোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধী থেকে অখিলেশ যাদব, জিনপিং থেকে ঋষি সুনাক- সকলকে নিয়েই সে কথা বলেছে। প্রয়োজনে টিপ্পনিও কেটেছে। আর তার মিষ্টি মুখ, গোল গোল চোখের পাশে অমন একটা মজাদার কথা পেয়ে কেউ না-হেসে বা তারিফ না করে থাকতে পারেনি। কবে যেন বিজ্ঞাপনের কন্যা ভারতীয় সাংস্কৃতিক জীবনেরই অঙ্গ হয়ে গিয়েছে।
আরও শুনুন: সুমন যেন অমোঘ সংক্রমণ, বাঙালিকে আধুনিক উচ্চারণে বলতে শেখালেন ‘তোমাকে চাই’
সিলভেস্টার ডা’কুনহা দেশের বিজ্ঞাপন জগৎকে শুধু সমৃদ্ধই করেননি, বরং সে-দুনিয়ায় একটা নতুন দরজা খুলে দিয়ে গিয়েছেন। ১৯৬০-এর দশকে যদিও ‘আটার্লি বাটার্লি ডিলিশিয়াস’-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তার ব্যাকরণগত ভুল-ত্রুটি নিয়ে। তবে সে সমালোচনা অস্ত গিয়েছে কালের গর্ভে। বর্তমানে এই আমূল গার্লের চার হাজারের বেশি বিজ্ঞাপন তৈরি হয়েছে। আসলে আমূল-বালিকার বেশ ধরে দেশের বিজ্ঞাপন যেন এক পরিবর্তনশীল ভারতের কথা বলেছে নিরন্তর। অন্যান্য ব্র্যান্ড-কেও নিজের কথা বলে ফেলার অভ্যাস করিয়েছে এই আমূল-বালিকা। শোনা যায়, অমিতাভ বচ্চন নাকি তাঁর সিনেমা নিয়ে আমূল গার্লের সব পোস্টার সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছেন।
বাংলায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের প্রয়াণের পর ‘বেলাশুরু’ ছবিমুক্তির সময় আমূল-বালিকার বিজ্ঞাপনটি মনে ধরেছিল সংস্কৃতিপ্রেমীদের।
আসলে, আমূল-বালিকা ভারতবাসীর গহন মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা কথাটির বক্তা হয়ে উঠেছে। আর তাই বড় কোনও ঘটনা ঘটলে, আজও আমরা খুঁজি যে, ছোট্ট মেয়েটি কী বলল! আসলে সে তো আমাদের না-বলা কথাটিই বলে ফেলবে সকলের সামনে। ছোট মুখে বড় কথা দিব্যি মানায়, যদি কথাখান হয় কথার মতো। আর ছোটরাই সেই মোক্ষম কথাটি বলে ফেলার সাহস রাখে। ডা’কুনহার আমূল-বালিকা সেই সত্যি বলার সৎসাহসেই মুগ্ধ করে রেখেছে দেশবাসীকে। স্রষ্টা চলে গেলেও আমূল-কন্যার ইন্দ্রজাল কখনও ভুলবে না ভারতবাসী।