দোকানের নাম ‘দুই ভাই’। সাইনবোর্ডে সেই নামের পাশেই, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশেষ চিহ্ন আঁকা। এমনই এক ছবি সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছিল নেটদুনিয়ায়। জানা গিয়েছিল, দোকানটা একইসঙ্গে চালান এক হিন্দু ও এক মুসলিম ব্যক্তি। স্বাভাবিক ভাবেই এই ছবি ঘিরে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়েছিল নেটদুনিয়ায়। কিন্তু সত্যিই কী তাই? নাকি ভাইরাল ছবির নেপথ্যে লুকিয়ে আছে অন্য কোনও কাহিনি? খোঁজ নিলেন শুভদীপ রায়।
কথায় আছে, যা রটে তার কিছু তো বটে। তবে এক্ষেত্রে সেই ‘কিছু’-র প্রায় নেই বললেই চলে। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া এক ছবির সত্যতা খুঁজতে গেলে যে কেউ অবাক হতে বাধ্য। না মিলবে সেই ছবির দৃশ্য, না মিলবে ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বার্তা। কিন্তু কেন এমন অসামঞ্জস্য? তা জানতে আমাদের ফিরে দেখতে হবে ভাইরাল ছবিটিকে।
আরও শুনুন: বোন মুসলিম ভাই হিন্দু, মায়ের শেষকৃত্যের রীতি নিয়েই বাধল জোর বিবাদ
ছবিটি শহরের এক ছাপোষা দোকানের। যে দোকানের নাম ‘দুই ভাই’, আর তার সাইনবোর্ডে আছে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের বিশেষ চিহ্ন। সুতরাং ধরে নেওয়া হয়েছে যে, দোকানের দুই ভাই দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। এরকম দোকান কি সত্যিই আছে? কুঁদঘাট মেট্রো স্টেশন থেকে একটু এগিয়ে এলে এরকম এক দোকানের সত্যিই হদিশ মেলে। টালিগঞ্জ চণ্ডীতলা মোড়ের অনতিদূরে সত্যনারায়াণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। ঠিক তার লাগোয়া এই ‘দুইভাই’ দোকান। মূলত চামড়ার জুতো-ব্যাগ এইসব সারাই হয় এই দোকানে। দোকানের বর্তমান মালিক বরুণ দাস। দোকানের বয়স নেহাত কম নয়। বরুণবাবু জানাচ্ছেন, তাঁর বাবার আমলে তৈরি এই দোকান। একসময় তাঁর বাবা ও কাকা একই সঙ্গে চালাতেন। সেই অর্থেই দোকানের নাম রাখা হয় ‘দুই-ভাই’। এলাকায় যথেষ্ট পরিচিত এই দোকান। তবে অন্য কোনও কারণে নয়। দীর্ঘদিন এলাকায় চামড়ার জিনিসপত্র সারানোর একমাত্র ঠিকানা ছিল এই দোকান-ই। যদিও বরুণবাবুরা বাংলার বাসিন্দা নন। বিহার থেকে এসেছিলেন এখানে ব্যবসা করতে। তাই তাঁরা বাবা ও কাকা পালা করে দোকান চালাতেন। ২-৩ মাস অন্তর একজনকে এখানে রেখে বিহারে দেশের বাড়িতে যেতেন অন্যজন। অনেকগুলো বছর এভাবেই কেটেছে। বাংলায় এমন দোকানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাই অন্যান্য দোকানের মতোই স্বাভাবিক ভাবেই এই দোকানে ব্যবসা করত দাস পরিবার।
আরও শুনুন: হিন্দু গড়ে শান্তিতেই আছেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা! অযোধ্যায় হেলায় জিতলেন মুসলিম প্রার্থী
সময়ের সঙ্গে বরুণবাবুর হাতে দায়িত্ব আসে। দোকানের যাবতীয় কাজকর্ম তিনিই সামলাতে শুরু করেন। তাঁকে সাহায্যের জন্য থাকতেন তাঁর কাকার ছেলে সাগর দাস। বাবা-কাকার মতোই এই দুই ভাই-ও পালা করে দোকানে থাকতেন। প্রজন্ম পালটালেও দোকানের নামে একই ভাবে অর্থবহ থেকে যায়। অর্থাৎ এই দুই ভাইয়ের একজন হিন্দু ও অন্যজন মুসলমান, তা কিন্তু নয়। তাহলে এই দুই ধর্মের চিহ্ন এল কোথা থেকে? তার উত্তর মেলে বরুণবাবুর কথাতেই। কোনও একসময়, বরুণবাবু তখন বিহারে, দোকানের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ভাই সাগর। তো তাঁর নাকি খুব আঁকার শখ। সাইনবোর্ড আঁকা, বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি আঁকা- সময় পেলেই এইসব করতেন তিনি। সেই সাগরবাবুই একদিন কাজের ফাঁকে দোকানের বাইরে কায়দা করে ‘দুই-ভাই’ লিখে ফেলেন। আর মনের খেয়ালে পাশে এঁকে দেন ওই দুই ধর্মের চিহ্ন। কিছুদিন পর ফিরে আসেন দাদা বরুণ। ভাইয়ের কাণ্ড দেখে তিনি একটু অবাকই হন। বুঝতে পারেন, মনের খেয়ালে ভাই যা করেছেন তার অর্থ তো অন্য অনেক কিছু বোঝাচ্ছে। তাই ঠিক করেন এই চিহ্ন মুছে ফেলবেন। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও তো সবসময় সামর্থ্য থাকে না। তাই সেই মুহূর্তে ওই ছবি মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। সেই সময়কার তোলা ছবিই ভাইরাল হয়েছে নেটদুনিয়ায়।
আরও শুনুন: ভিড় ট্রেনে নমাজ পড়ে ইফতার, মুসলিম সহযাত্রীদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ালেন হিন্দুরা
এদিকে ভাইরাল ছবি দেখে অনেকেই দোকানের খোঁজ নিতে হাজির হচ্ছেন। তাতে খানিক আশঙ্কাতেই ভুগছেন বরুণবাবু। তবে তিনি সাফ জানালেন, এই দোকানের দুই ভাই কোনওভাবেই দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষ নন। বছর চারেক আগে ‘ভুল’ করে এঁকে ফেলা ওই চিহ্নের নেপথ্যে বিশেষ কোনও কারণ ছিল না। হয়তো দুই ধর্মের খরিদ্দাররা আসেন দোকানে, সেই ভাবনা থেকেই এই চিহ্ন এঁকেছিলেন বরুণবাবুর ভাই। তাঁর কথায়, ‘ভাই মনের খেয়ালে এই কাজ করেছিল। এতে তাঁদের কোনও দোষ নেই।’ আশেপাশের দোকানিরাও জানালেন, এই দোকানদাররা কেউই ভিন্ন ধর্মের নন। ইতিমধ্যে দোকান সংস্কারের কাজ করেছেন বরুণবাবু। ফলত সেই পুরোনো ঢঙে লেখা ‘দুই ভাই’ সাইনবোর্ড আজ আর দেখা যায় না। নতুন সাইনবোর্ডে ধর্মের কোনও চিহ্ন নেই। শুধু দোকানের নামটিই লেখা।
আরও শুনুন: হিন্দুর সন্ন্যাসের উপবাসের পাশেই মুসলমানের রমজান, দুই ধর্মের অপূর্ব সাদৃশ্য চৈত্রের বাংলায়
গোটা দেশেই যখন সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ বাড়ছে, তখন এরকম সম্প্রীতির ছবি দেখে হয়তো স্বস্তিই পেয়েছিলেন নেটিজেনরা। যদিও বাস্তব বলছে একেবারে আলাদা কথা। দোকানের দুই ভাই ভিন্ন ধর্মের মানুষ নন। সচেতন ভাবে সম্প্রীতির বার্তাও হয়তো তাঁরা দিতে চান না। তবে, একদিন ‘মনের ভুলে’ যে সহাবস্থানের ছবি এঁকেছিলেন বরুণবাবুর ভাই, তাই-ই তো আমাদের অনেকের মনের কথা। দুই ভাইয়ের মতোই তো এদেশে আছেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। পুরনো সাইনবোর্ড তাই উধাও হলেও, একজন আপনভোলা মানুষের ভাবনায় যে সম্প্রীতি ধরা দিয়েছিল একদিন, তাকে নাকচ করা যায় না কোনওভাবেই। ‘দুই ভাই’ দোকান এখন আর সেই সম্প্রীতির চিহ্ন বহন করছে না, তবে সম্প্রীতি বজায় রেখে আমজনতা যদি দুই ভাই হয়েই থাকে, তবে মন্দ কী!