ছোটখাটো চেহারা। পরনে রংচটা শাড়ি। চোখে মুখে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু মুখের হাসি সেই সমস্ত মলিনতা মুছে দেয়। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এভাবেই হাসিমুখে ব্যবসা করছেন এই ‘ঠাকুমা’। এখনও মাত্র ৩০ টাকায় ভরপেট খাবার মেলে তাঁর হোটেলে। আর উপরি পাওনা হিসেবে মেলে আন্তরিকতা। কোথায় রয়েছে সেই হোটেল? খোঁজ নিলেন শুভদীপ রায়।
গড়িয়াহাট মোড় থেকে হিন্দুস্থান পার্কের দিকে মিনিট পাঁচেক। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ডানপাশে একটা বড় বটগাছ। তার নীচেই হোটেল। কোনও ঝাঁ চকচকে আয়োজন নেই। এমনকি লাইট, পাখা, কিছুই নেই। বসার জন্য স্রেফ দুটো কাঠের বেঞ্চ। আর সেখানেই দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ব্যবসা চালাচ্ছেন এক বৃদ্ধা।
আরও শুনুন: ইনি ঋষি সুনাকের শাশুড়ি! সাদাসিধে সুধা মূর্তিকে দেখে বিশ্বাসই হয়নি বিমানবন্দর কর্মীর
এই হোটেলের কোনও নির্দিষ্ট নামও নেই। সবার কাছে ‘ঠাকুমার হোটেল’ হিসেবে পরিচিত। ছুটির দিন বাদে, রোজই খোলা। ১১:৩০ টা থেকে বড়জোর ৪ টে, তার মধ্যেই সব খাবার শেষ। তাই বাসি খাবার পরিবেশনের প্রশ্নই ওঠে না।
অনেকেই এই কারনে এখানে নিয়মিত খেতে আসেন। বিশেষত, যাঁদের এই এলাকায় অফিস, তাঁদের দুপুরের খাবার ঠিকানা এই ঠাকুমার হোটেল। শুধু তাই নয়, এখানকার খাবারের স্বাদও নাকি একেবারে বাড়ির মতোই। এমনটাই দাবি হোটেলের নিয়মিত গ্রাহক সোমনাথ দত্তের। তিনি বিগত ৩ বছর ধরে অফিস যাওয়ার আগে এখানে খেতে আসেন। একইসঙ্গে এখানে খাবারের দামও যথেষ্ট কম। তাই তাঁর মতো আরও অনেকে এখানে দুপুরের খাবার খেয়ে যান।
আরও শুনুন: পুরুষের প্রবেশ নিষেধ, শুধু মহিলাদের জন্যই দেশে তৈরি হচ্ছে ২৫০টি ‘পিঙ্ক পার্ক’
ঠিক কী কী খাবার থাকে রোজকার মেনুতে?
সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন খোদ দোকানের মালকিন। দোকানের একমাত্র কর্মচারীও তিনিই। বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। কিন্তু এখনও নিজে হাতেই প্রায় সবটা সামলান। রান্না করা থেকে আরম্ভ করে, খাবার পরিবেশন, হিসাব করে দাম নেওয়া, সব কিছুই তিনি একা করেন। এমনকি রোজকার বাজারও তাঁকেই করতে হয়। তথাকথিত হোটেলের মতো মেনুকার্ডের ব্যবস্থা এখানে নেই। খাবারের সংখ্যাও সীমিত। সাধারণ ভাত ডাল তরকারি, তার দাম ৩০ টাকা। এর সঙ্গে ডিম থাকলে দাম হয় ৪০, মাছের ক্ষেত্রে ৫০ আর মাংস ভাতের দাম ৬০ টাকা। ব্যস এই চার ধরনের খাবার পাওয়া যায় ঠাকুমার হোটেলে। সেইসঙ্গে থাকে চাটনি আর পাঁপড়। একেবারেই ঘরোয়া ভাবে রান্না, কিন্তু যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করেন বৃদ্ধা। রান্না করেন মূলত উনুনে। গ্যাসের কোনও ব্যবস্থা নেই।
আরও শুনুন: SPECIAL PODCAST: প্রচেত গুপ্ত-র গল্প ‘একদা এক বলাইবাবুর গলায়’
রোজ ভোর পাঁচটায় খুলে দেন দোকানের ঝাঁপি। তখন যদিও কিছুই খাবার মেলে না। সেই ভোর থেকেই শুরু করেন রান্না, যা শেষ করতে বেজে যায় ১১ টা। প্রতিদিনই অন্তত ৫০ জনের হিসাব করে রান্না করেন। কোনওদিন সবটা ফুরোয়, কোনওদিন বাকি থাকে। কিন্তু কখনই সেই বেঁচে যাওয়া খাবার জমিয়ে রাখেন না। আর এই হোটেলের উপর ভর করেই আটজনের সংসার চালান তিনি। বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের তেমন রোজগার নেই। যদিও সে বিষয়ে কোনও আক্ষেপ নেই তাঁর। হাসিমুখেই এতগুলো দিন এই হোটেল চালিয়ে আসছেন। তবে এতদিন সঙ্গী হিসেবে স্বামীকে পাশে পেতেন। মহিলার সঙ্গে তিনিও হোটেলের কাজে কিছুটা হলেও সাহায্য করতেন। মাস চারেক আগে তিনিও মারা গিয়েছেন। তাই এখন সব দায়িত্ব একা হাতেই সামলাতে হয় তাঁকে।
যদিও যে কোনও সমস্যায় স্থানীয় প্রশাসনের তরফে সাহায্য পান বলেই জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু গাছের নীচে দোকান, ঝড় জলে মারাত্মক বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে, সেক্ষেত্রে ঠিক কী ব্যবস্থা নেন তিনি? উত্তর দেওয়ার সময় ভগবানের নাম করে বললেন, এখনও তেমন কোনও বিপদের মুখে পড়েননি। ভবিষ্যতেও তেমন কিছু হবে না এই আশাই করেন।
তবে দোকানের কোনও উন্নতি করা সম্ভব নয়। সেই আর্থিক সংগতি তাঁর নেই। এতদিন যেভাবে গাছের নীচেই হোটেল চালিয়ে আসছেন, আগামী দিনেও তেমনটাই বজায় রাখবেন বলেই জানিয়েছেন এই ঠাকুমা। সেই একইরকম প্রার্থনা হোটেলের গ্রাহকদের। এখানে যেমন আন্তরিকতার সঙ্গে খাবার পরিবেশন করা হয়, তা সবসময় বজায় থাকুক এমনই ইচ্ছা তাঁদের সকলের।