জন স্টোনস তো আদতে সেন্টার ব্যাক। এতদিন ৪-২-৩-১ ছকে তিনি তাই খেলতেন। কিন্তু পেপ সেই ফর্মাশনেরই আরেকটা ডেরিভেটিভ তুলে আনলেন। ফরমেশন ৩-২-৪-১। অর্থাৎ দেখে মনে হবে তিন জন ডিফেন্স, আসলে কিন্তু চারজন ডিফেন্স। ডিফেন্সের প্লেয়ারকে যে এই ভাবে ডাবল রোলে খেলানো যায়, তাও আবার এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে, পেপ-এর কৌশল না দেখলে তা যেন বিশ্বাসই করা যায় না। বিস্ময়-ম্যাচের বিশ্লেষণে শঙ্খ বিশ্বাস।
বর্তমান প্রজন্মের সেরা ফুটবল কোচ কে? এই প্রশ্ন করলে বেশ কয়েকটি নাম উঠে আসবে। কেউ বলবে হোসে মরিনহো, তো কারুর কাছে আলেক্স ফার্গুসন। কেউ বলবে জিদান, কেউ আন্সেলোত্তি তো কেউ পেপ গুয়ার্দিওলা। যে কটি নাম সামনে এল, এঁদের প্রত্যেকেই তাঁদের কোচিং জীবনে অসম্ভব সফল। তবে এই মুহূর্তে কথা শুধু পেপ-কে নিয়েই। যাঁর স্ট্র্যাটেজি ইউরোপের অন্যতম প্রধান শক্তিধর ফুটবল দলকে পাড়ার ক্লাব পর্যায়ে প্রায় নামিয়ে আনতে পারে, তাঁকে নিয়ে কথা না বলে উপায়-ই বা কী!
পেপ গুয়ার্দিওলা। বছর ৫২-র এই মাস্টারমাইন্ড ট্যাক্টিশিয়ানের জন্ম স্পেনে। যাঁর প্রায় পুরো খেলোয়াড় জীবনটাই কেটেছে বার্সার মতো ক্লাবে। নিজে খেলতেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। ছিলেন জোহান ত্রুয়েফের বিখ্যাত বার্সা টিমের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ারদের একজন। যাঁরা বার্সার ফুটবল ইতিহাসের প্রথম ইউরোপিয়ান কাপ, এবং টানা ৪ বার স্পেনের জাতীয় লিগ শিরোপা জিতেছিল। কিন্তু ওই যে কথায় বলে না, যে, সব ভালো ছাত্রই ভালো শিক্ষক হয় না! তেমনি সব ভালো প্লেয়ার কিন্তু ভালো কোচ হন না। এরম উদাহরণ ফুটবল ইতিহাস ঘাঁটলে ভুরিভুরি মিলবে।
আরও শুনুন: ফুচকা বিক্রি করা ছেলেটাই এখন খ্যাতির শীর্ষে, প্রেরণা জোগাচ্ছে তরুণ যশস্বীর সংগ্রাম
তবে এখানেই হয়তো পেপ আলাদা। ২০২২-২৩-এর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে ঘরের মাঠে রিয়াল মাদ্রিদের মতো টিমকে আক্ষরিক অর্থেই ধুলোয় মিশিয়ে দিল এই লোকটির ট্যাক্টিক্স। খেলা দেখতে দেখতে মনেই হচ্ছিল না যে, উল্টোদিকের টিমটির নাম রিয়াল মাদ্রিদ। যারা জানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগটা কীভাবে জিততে হয়। এহেন টিমকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করল পেপের ম্যানচেস্টার সিটি।
এই প্রজন্মের সবচেয়ে ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন কোচকে সচক্ষে কোচিং করাতে দেখা তাই একরকম সৌভাগ্যই বলতে হয়।
সালটা ২০০৮-০৯ , চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। বার্সা বনাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। বিপক্ষের কোচ আলেক্স ফার্গুসন। রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ওই ম্যাচটির কথা আজও ফুটবলপ্রেমীর চোখে ভাসে। ফার্গুসনের সেই টিমকে শুধু ‘তিকিতাকা’ খেলে নাস্তানাবুদ করেছিলেন পেপ। আর তারপর তো সেই বিখ্যাত মেসির হেড। সে কথা সবার মনে আছে নিশ্চয়ই। নিজের জাত চিনিয়েছিলেন সেদিন গুয়ার্দিওলা।
আরও শুনুন: নামে নয়, প্রণামেই বড় হয় মানুষ… আপনি আচরি ধর্ম শেখালেন অরিজিৎ
আসলে পেপ গুয়ার্দিওলার সঙ্গে বাকি কোচেদের তফাৎটা সূক্ষ্ম, অথচ বৃহৎ। লোকটা বরাবর হাইপ্রোফাইল প্লেয়ারদের নিয়েই পারফর্ম করেন। বার্সেলোনা, বায়ার্ন, ম্যান সিটির মতো বড় ক্লাব, তাবড় সব প্লেয়ার। তা সত্ত্বেও কোথাও গিয়ে আসল তফাতটা গড়ে দেয় কিন্তু ওই লোকটির বুদ্ধি ও ফুটবল-দর্শন। মাঠের প্লেয়ারদের মতোই লোকটাও পারফর্ম করেন মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে, এবং অত্যন্ত ধারাবাহিক ভাবেই করে থাকেন। নিজের পরিকল্পনায় মাঠকে ছোট ছোট অংশে ভেঙে গুটি সাজান সব কোচই, তবে পেপ যেন আরো একটু বেশিই ভাঙেন। ওয়ান বাই টু, থ্রি বাই টু, টু বাই ওয়ান, থ্রি বাই ওয়ান- কৌশলে কীভাবে বল বার করা যায় সেটা পেপের থেকে ভাল আর কেই বা জানেন!
উইং প্লে-তে খুব একটা বিশ্বাসী নন পেপ । বরাবরই তাঁকে দেখা যায় ফরমেশন অনুযায়ী পাস খেলতে খেলতে মাঝমাঠ থেকে বল তুলে ধীরে ধীরে একটা সময় অপোনেন্টের ডিফেন্সিভ এরর খুঁজেই বলটা ঠিক জায়গায় রাখা এবং বক্সে এনে ফেলা। এতে প্রতিপক্ষ পায়ে বল না পেয়ে দিশাহারা হয়, বিরক্ত হয়, আক্ষরিক অর্থেই নাজেহাল হয়। ফলস্বরূপ প্রতিপক্ষ ভুল করতে বাধ্য হয় আর পেপ এই ভুলের অপেক্ষাতেই থাকেন। এই তো এই সেমিফাইনাল ম্যাচের কথাই ধরা যাক।
জন স্টোনস তো আদতে সেন্টার ব্যাক। এতদিন ৪-২-৩-১ ছকে তিনি তাই খেলতেন। কিন্তু পেপ সেই ফর্মাশনেরই আরেকটা ডেরিভেটিভ তুলে আনলেন। ফরমেশন ৩-২-৪-১। অর্থাৎ দেখে মনে হবে তিন জন ডিফেন্স, আসলে কিন্তু চারজন ডিফেন্স। স্রেফ দুটো পিভটের একজনকে উপরে তোলা, আর একটা সেন্টার ব্যাককে পিভট খেলানো। যে চকিতে বলটা ধরে উপরে উঠে আসবে। এই ম্যাচেও এই কাজটাই গোটা ৯০ মিনিট জুড়ে করে গেল জন স্টোনস। ভাবা যায়! মাদ্রিদ যত গুন্দোগান আর রডরিকে ধরতে গেল, সেই সুযোগে ফ্রি স্পেসগুলোতে বারবার বল নিয়ে ডান উইংয়ে পাস্ করে গেল স্টোনস। আবার প্রতিপক্ষের বিল্ড আপের ক্ষেত্রে যথাসময় ঠিক ডিপ ডিফেন্সে নেমে এলেন স্টোনস। বলতে গেলে ম্যাচের মূল পার্থক্যটাই গড়ে দিল স্টোনস-কে এরকম অভিনব ভাবে পেপের ব্যবহার। একজন ডিফেন্সের প্লেয়ারকে যে এই ভাবে ডাবল রোলে খেলানো যায়, তাও আবার এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে, পেপ-এর স্ট্র্যাটেজি না দেখলে তা যেন বিশ্বাসই করা যায় না।
পেপ তাঁর কোচিং জীবনে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন দুবার ,দুবারই বার্সার হয়ে। বায়ার্ন-এর হয়ে তাঁর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ঝুলি শূন্য। সিটি-কে ফাইনালে তুলেও শেষবার ফিরতে হয়েছিল খালি হাতে। তবে এবার আরও একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে পেপের দল ম্যানচেস্টার সিটি। প্রতিপক্ষ ইতালির জায়ান্ট ক্লাব ইন্টারমিলান। এখন এটাই দেখার ফাইনাল ম্যাচেও আধুনিক ফুটবলের আইনস্টাইন আবারও নিজের ছাপ রাখতে পারেন কি-না।