তিনি ঈশ্বর। তিনি পৃথিবী। তিনি আমাদের ভালোবাসা। শচীন তেণ্ডুলকর। যে নামের সামনে নতজানু ভারতবাসী। আগেও ছিল, এখনও আছে। গোটা বিশ্ব যে বিস্ময় প্রতিভাকে স্মরণ করে সম্ভ্রমে। তাঁরই ৫০তম জন্মদিনে সংবাদ প্রতিদিন-এর আয়োজন ‘বাহ্ শচীন’। নিরলস সাধনায় যে সাধক দেশকে এনে দিয়েছেন অনন্ত ঐশ্বর্য, তাঁকেই ফিরে ফিরে দেখা স্বজন, সতীর্থদের চোখে। আসুন মেতে উঠি এই শচীন পার্বণে।
ঝুলন গোস্বামী: একদম ছোটবেলায় আমি ফুটবল আর সেই সূত্রে ছিলাম মারাদোনার ভক্ত। ৯২-এর বিশ্বকাপ থেকেই আমার ক্রিকেট দেখা শুরু। ঘটনাচক্রে সেটা শচীন স্যরেরও প্রথম বিশ্বকাপ। ক্রিকেট আর শচীন দুই-ই আমার কাছে এসেছিল প্রায় একই সঙ্গে। একটা বিজ্ঞাপনের জনপ্রিয় ক্যাচলাইন ছিল- ইট ক্রিকেট, ড্রিঙ্ক ক্রিকেট, স্লিপ ক্রিকেট। আমার ক্ষেত্রে এই কথাটা যেমন ক্রিকেটের জন্য, তেমন শচীন স্যরের জন্যও প্রযোজ্য। তখন কে-ই বা জানত যে, আমি ফাস্ট বোলার হব! বেশ মনে আছে, আমাদের ছোটবেলায় চুইং গামের সঙ্গে ক্রিকেটারদের ছবি পাওয়া যেত। আমি শুধু শচীনের ছবি পাওয়ার লোভেই ওটা কিনতাম। বলতে গেলে ওঁর জন্য পাগল ছিলাম, ক্রিকেট যে আমি একসময় ভালবেসে ফেললাম, তা ওঁর জন্যেই।
আরও শুনুন: Sachin@50: শচীনের ব্যাট নিয়েও খেলেছি, আমার কাছে শচীনই ‘গ্রেটেস্ট’
এই গেল ছোটবেলার পাগলামি। যখন খেলতে এলাম, বুঝলাম শচীন এক অতলান্ত মহাসাগর। মুম্বইয়ে ওঁকে প্র্যাকটিস করতে দেখেছি, কিন্তু কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সেই মানুষটাকে ২০০৭ সালে যখন প্রথম সামনাসামনি দেখলাম আমার তো হাত-পা কাঁপছে। ওঁর সঙ্গে কথা বলব কী, জিভ যেন সরতেই চায় না। আমার সঙ্গে দু’জন সিনিয়র খেলোয়াড় ছিলেন, তাঁরা জানতে চাইলেন, আমার হয়েছেটা কী! কী করে বোঝাব! যে মানুষটাকে খেলতে দেখে আমার এই খেলায় আসা, তাঁকে সামনে দেখলে, যা হওয়ার তাই-ই হয়েছিল। মনে হয়েছিল যেন, স্বপ্নের ভিতর দাঁড়িয়ে আছি। শচীন স্যর সেদিন আমাদের ডায়েট, ট্রেনিং নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমার কেরিয়ারে সেই পরামর্শ খুব কাজে লেগেছিল। দীর্ঘ সময় খেলাটা চালিয়ে যেতে গেলে কী কী করা দরকার, তা খোলামনেই সেদিন জানিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। ওঁর সঙ্গে আমার কেরিয়ারের একটা অস্বস্তিকর সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করি। ওঁকে যখন অধিনায়কত্ব থেকে সরানো হয়েছিল, তখন কেউ ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই। আমি দুঃখ পেয়েছিলাম, ভেঙে পড়েছিলাম, বিষণ্ণ হয়েছিলাম। পরে যখন শচীন স্যরের আত্মজীবনী পড়ি, তখন দেখি সেখানে স্যর লিখেছেন, কেউ তাঁকে অধিনায়কত্ব থেকে বাদ দিতেই পারেন, কিন্তু তাঁর খেলা থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন না। এই একটা কথা যেন ভিতরে ভিতরে আমাকে তাতিয়ে দিল। ঠিক করলাম, আমিও নিজেকে এমনভাবে তৈরি করব, যাতে যতদিন ক্রিকেট খেলব নির্বাচকরা যেন আমাকে বাদ না দিতে পারেন। আমি নিজের কাছেই নিজের সেই প্রতিজ্ঞা রেখেছিলাম, আর নেপথ্যে থেকে গিয়েছিলেন শচীন স্যর। ২০১৭ বিশ্বকাপে লর্ডসে ফাইনালের আগে শচীন স্যর আমাদের ড্রেসিংরুমে এসেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে ওটা আমার কাছে খুব স্মরণীয় একটা মুহূর্ত। ওঁর উপস্থিতি যেন আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমরা সত্যিই বিশেষ কিছু একটা করে উঠতে পেরেছি। তাই উনি এসেছেন।
আরও শুনুন:Sachin@50: চাপ সামলানোর ক্ষমতা ছিল ঐশ্বরিক, আমরা শচীনকে দেখেই শিখি
আমি বহুবারই একজন ফাস্ট বোলারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শচীন স্যরকে দেখা-বোঝার চেষ্টা করেছি। আর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ২০০০ সালের নাইরোবির আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। পিচ তো ছিল ফাস্ট বোলারের স্বর্গরাজ্য, সেখাবে ম্যাকগ্রাকে যেভাবে খেলেছিলেন, তার তুলনা হয় না। কিংবা চিপক-এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওঁর লড়াইও ভোলার নয়। একে তো চোট পেয়েছিলেন, অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই খেলছিলেন। তার উপর ওই গরম। কিন্তু কোথায় কী! তিনি খেলে চলেছেন রাজকীয় মেজাজে। এই একটা ইনিংস বুঝিয়ে দেয় তাঁর মানসিক শক্তি ঠিক কতখানি। খেলাকে তিনি ঠিক কতটা ভালবাসেন, শত প্রতিকূলতার ভিতরও যে কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, তা এই ইনিংস থেকে শেখা যায়। খেলার সঙ্গে আমরা যারা জড়িত, তাঁদের সকলের কাছেই এটা শিক্ষণীয়। শৃঙ্খলা, দৃঢ়তা আর খেলার প্রতি ভালবাসা- এই তিনটি জিনিসই আমি তাঁর থেকে শিখেছি। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তিনি যেভাবে উৎসাহিত করেছেন, তাতে তাঁর কাছে শুধু কৃতজ্ঞই থাকা যায়। এমনি এমনি তো আর সারা দেশের ক্রিকেটভক্তরা তাঁকে ঈশ্বর আখ্যা দেননি! তিনি সত্যিই ক্রিকেটের ভগবান। ৫০তম জন্মদিনে তাঁকে আমার শুভেচ্ছা জানাই।