শচীন তেন্ডুলকর যদি বিপক্ষের বোলারকে মাঠের বাইরে ফেলেন তাহলে, সারা দেশ আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠত! সেখানে ধর্ম, শ্রেণি এসব কোথায়! জাহির খান যখন প্রতিপক্ষের স্টাম্প ছিটকে দিতেন, তখনও একই আনন্দ অনুভব করতাম আমরা। কেননা এই সব মুহূর্তে আমরা দেশবাসী হিসাবেই সংঘবদ্ধ। খেলা তো আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে আগাগোড়া। তাহলে আজ সেই সংস্কৃতিকে কেন নষ্ট করছি আমরা? উত্তরের খোঁজে শঙ্খ বিশ্বাস।
১৩০ কোটির দেশ আমাদের। হিন্দু ,মুসলিম, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ- নানা ধর্মের মানুষের ব্যাস এই দেশে। আর সংবিধান বলে, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ছোট থেকে অন্তত আমরা তেমনটা জেনেই বড় হয়েছি। আর ক্রিকেট হল এমন একটা খেলা যা এই সব ধর্মের মানুষকে এক সূত্রে বেঁধে রাখে । ক্রিকেট নিয়ে আমাদের দেশে যে পাগলামি, যে উন্মাদনা তা বোধহয় বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। আর তাই তো অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি স্টিভ ওয়া একবার বলেছিলেন- “In India, Cricket isn’t just a sport, it’s a religion”, তবে এবার কিন্তু সেই ধর্মেও বিভাজনের রাজনীতি ঢুকে পড়ছে একটু একটু করে।
আরও শুনুন: ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত, তবু স্বপ্ন ছিল রোনাল্ডোকে দেখার, খুদে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করলেন CR7
আহমেদাবাদ টেস্ট চলাকালীন, গ্যালারি থেকে করা একটা ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। বাউন্ডারি লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন সূর্যকুমার, মহম্মদ শামিরা। আর দর্শকরা তাঁদের নাম ধরে চিৎকার করছেন। সূর্যকুমার প্রত্যুত্তরে দর্শকদের নমস্কার করে অভিবাদনও জানাচ্ছেন। কিন্তু তার পরই দেখা যায় ওই মুষ্টিমেয় দর্শকই শামিকে উদ্দেশ্য করে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিচ্ছে। ঘটনাটি ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার আমদাবাদ টেস্টের প্রথম দিন। যদিও শামি বা ভারতীয় দলের অন্য ক্রিকেটাররা এ নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে এই ঘটনা কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্নই তুলে দেয়।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন, খেলার মাঠে এই ধরনের স্লোগান কেন দেওয়া হবে? একজন খেলোয়াড় নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী বলেই তাঁর প্রতি এরকম আচরণ করা হবে, এ কখনোই কাম্য নয়। বরং এই ঘটনা খেলার মাঠের স্পিরিটকেই আঘাত করে। খেলা- সে ক্রিকেট হোক বা ফুটবল – আসলে সমস্ত বিভাজনকে মুছেই দেয়। মাঠে যাঁরা খেলছেন, তাঁরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হতেই পারেন। মাঠের বাইরে যাঁরা দেখছেন, তাঁরাও নানা ধর্মের মানুষ হতেই পারেন। তাঁদের অর্থনৈতিক শ্রেণিগত অবস্থানও ভিন্ন হতে পারে। তবে খেলার ধর্মের এইসব বিভেদের তো কোনও ঠাঁই নেই। শচীন তেন্ডুলকর যদি বিপক্ষের বোলারকে মাঠের বাইরে ফেলেন তাহলে, সারা দেশ আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠত! সেখানে ধর্ম, শ্রেণি এসব কোথায়! জাহির খান যখন প্রতিপক্ষের স্টাম্প ছিটকে দিতেন, তখনও একই আনন্দ অনুভব করতাম আমরা। কেননা এই সব মুহূর্তে আমরা দেশবাসী হিসাবেই সংঘবদ্ধ। খেলা তো আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে আগাগোড়া। সব বিভাজন সত্ত্বেও আমরা যে ঐক্যবদ্ধ, একই দেশের নাগরিক হিসাবে একই রকম আনন্দ-বিষাদের সাক্ষী- এই উদারতার শিক্ষাই তো খেলা থেকে আমাদের পাওনা। তাহলে আজ সেই সংস্কৃতিকে কেন নষ্ট করছি আমরা?
আরও শুনুন: লক্ষ্য ছিল শুধু পাখির চোখে, মেসিকে এবার অর্জুনের সঙ্গে তুলনা মুকেশ আম্বানির
আরও একটি প্রশ্ন এখানে প্রাসঙ্গিক। খেলায় হার-জিত থাকে। প্রিয় দেশ হেরে গেলে ক্ষোভ হওয়া সংগত। যদিও তার একটা মাত্রা আছে। তবে সেই রাগ-ক্ষোভ কেনই বা সম্প্রদায়গত বিভাজনকে উসকে দেবে? এর আগেও অনেক বার দেখা গেছে কোনো কারণে দল হারলে, যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো সব দায় চাপানো হয় মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্লেয়ারের উপর! এইতো গত এশিয়া কাপে পাকিস্তানের কাছে হারার পর অর্শদীপ সিংয়ের ঘাড়ে সব দায় চাপানো হলো, এমন কি তাকে খালিস্থানি জঙ্গি পর্যন্ত বলা হল। আপনার কি মনে হয় কোনও খেলোয়াড় ইচ্ছে করে ম্যাচ হারায়? বিগত দিনে এরকম অসংখ নজির আমরা দেখেছি যেখানে ভারত হারলে, প্লেয়ারদের উপর মানুষ আক্রমণ তো করেছে এমন কি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের বাড়ির লোকও ছাড় পায়নি। সৌরভ-শচীন-দ্রাবিড়-শেহবাগ থেকে ধোনি কেউ বাদ যাননি, তালিকা তা অনেক লম্বা । আসলে আমরা ভুলে যাই যে ভারতের প্রতিনিধিত্ব যাঁরা করেন, তাঁরা জাতি ধর্ম ভুলে শুধু দেশের হয়েই খেলতে নামেন , দেশের জন্য নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিতে নামেন। তাঁদের কাছে কিন্তু খেলা টাই একমাত্র ধর্ম। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ ইচ্ছে করে এই খেলায় অর্থাৎ ক্রিকেটেও বিভাজনের রাজনীতি ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন। সময় এসেছে আমাদের, যারা একটু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, যাঁরা এই বিভাজনের বিপক্ষে তাঁদের সরব হওয়ার। কারণ এইভাবেই যদি চলতে থাকে সেই দিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন আমাদের সবার প্রিয় ক্রিকেটও তার গুরুত্ব হারাবে।এবং তার প্রভাব কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও পড়বে। কেননা, খেলা শ্রেণি, ধর্ম সব বিভাজন মুছে দেয়। শুধু খেলোয়াড়দের মধ্যে নয়, অনুরাগীদের মধ্যেও।