হিজাবের পর টিপু সুলতান ইস্যুতে ফের উত্তপ্ত কর্ণাটক। রাজনৈতিক নেতাদের মন্তব্য, পালটা মন্তব্যে জলঘোলা হচ্ছে আরও। কিছুদিন আগেই নেতাদের এই ধরনের মন্তব্য নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন শীর্ষ আদালতের বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন। দলগুলি সতর্ক না হলে এ ব্যাধি যে রোখা যাবে না, এমনটাই মত ছিল তাঁর। কর্ণাটকের ঘটনা সেই আশঙ্কাকেই যেন সত্যি করে তুলল।
অনেক সময়ই প্রকাশ্যে রীতিমতো উসকানিমূলক মন্তব্য করে বসেন জনপ্রতিনিধিরা। তাই তাঁদের জন্য লাগু করা হোক নয়া ‘কোড অফ কনডাক্ট’। এই মর্মে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হয়েছিল মামলা। বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে সেই আরজি নাকচ হয়ে গেলেও দলগুলিকে কড়াভাবে সতর্ক করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন। এই প্রথম নয়, রাজনৈতিক নেতামন্ত্রীদের বক্তব্যে ঘৃণাভাষণের ছড়াছড়ি নিয়ে বারেবারেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের শীর্ষ আদালত। কিন্তু বিচারপতির সাফ হুঁশিয়ারির পরেও কি নিজেদের সংযত করেছেন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা? টিপু সুলতান ইস্যুতে কর্ণাটকের সাম্প্রতিক বিতর্কে ফের উসকে উঠল সেই প্রশ্নই।
কী ঘটেছে ঠিক?
ধর্মের ইস্যু নিয়ে বিবাদ বিতর্কের জেরে বারেবারেই উত্তাল হয়ে উঠছে কর্ণাটক। হিজাব ইস্যু নিয়ে তোলপাড়ের পর এবার সে তালিকায় নয়া সংযোজন টিপু সুলতান। অভিযোগ, বিধানসভা ভোটের আগে কর্ণাটক রাজনীতিতে মেরুকরণের জন্য এবার অষ্টাদশ শতকের মাইসুরুর (মহীশূর) সম্রাটকেই হাতিয়ার করেছে গেরুয়া শিবির। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে একাধিকবার যুদ্ধে নেমেছিলেন টিপু সুলতান, এমনকি তাতে শহিদও হন তিনি। কিন্তু বিজেপির চোখে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শহিদ টিপু আসলে ‘হিন্দু-হত্যাকারী’। শ্রীরঙ্গপত্তনমে টিপুর মসজিদ আদতে মন্দির ভেঙে গড়া বলেও হিন্দুত্ববাদীদের অভিযোগ। আর এইভাবেই কর্ণাটকের রাজনীতিতে বরাবরই বিজেপির মেরুকরণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছেন টিপু সুলতান। বিধানসভা নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রেখে ফের সেই ইস্যুকেই সামনে তুলে এনেছে গেরুয়া শিবির।
সম্প্রতি এক জনসভায় দাঁড়িয়ে কর্ণাটক বিজেপির সভাপতি তথা সাংসদ নলিনকুমার কটীল বলেন, ‘‘কর্ণাটকের পবিত্র মাটিতে টিপু সুলতানের অনুগামীদের বেঁচে থাকাই উচিত নয়।’’ উপস্থিত জনতার সামনে তিনি প্রশ্ন তোলেন, এই দেশের কি টিপুর বংশধরদের দরকার, নাকি রামভক্তদের? তাঁর সাফ কথা, যারা রামের ভজন গায় কিংবা হনুমানের পূজা করে, কেবল তাদেরই এ দেশে থাকার অধিকার রয়েছে। আর যারা টিপুকে পছন্দ করে, তাদের এ দেশ থেকে বিদায় করার ডাক দেন তিনি। তাঁর ওই মন্তব্যের পরেই নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে কন্নড় রাজনীতিতে। এবার ওই নেতার মন্তব্যের পালটা দিলেন এআইএমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি। সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘‘আমি টিপু সুলতানের নাম নিলাম। দেখি তুমি আমার কী করতে পারো!’’ পরিকল্পিত ভাবে সে রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটাতে চাইছে বিজেপি, এই অভিযোগে সরব হয়েছে কংগ্রেসও।
আর এই প্রেক্ষিতেই ফের জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে বিচারপতি নাগরত্নের সতর্কবার্তা। ঘৃণাভাষণ দেশের সংবিধানের মূল ভিত্তির উপর আঘাত, এমনটাই বলেছিলেন তিনি। বস্তুত রাজনৈতিক বিরুদ্ধতা বজায় রাখতে গিয়ে অনেকসময়ই একাধিক নেতামন্ত্রী কুরুচিকর মন্তব্য করে বসেন। উসকানিও ছড়ায় তাঁদের কোনও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য। সাম্প্রতিক কালে এই ঘৃণাভাষণের প্রবণতা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন বিচারপতি। কিন্তু দেশের সংবিধান যেহেতু সকলকেই বাকস্বাধীনতার অধিকার দেয়, তাই এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উপরে বাড়তি নিষেধাজ্ঞা চাপাতে চাননি তিনি। তবে বিচারপতি নাগরত্ন এ কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রত্যেক মানুষের যেমন বাকস্বাধীনতা আছে, তেমনই সংবিধান মোতাবেকই কারও এমন কোনও মন্তব্য করার অধিকার নেই, যার জেরে অন্য সহনাগরিকের সম্মানহানি হয়। আর এই বিষয়টিতে নজর রাখার জন্যই রাজনৈতিক দলগুলিকে সতর্ক করেছিলেন তিনি। তবে শীর্ষ আদালতের সেই সতর্কতা সত্ত্বেও যে জারি রয়েছে ঘৃণাভাষণ, সে কথাই আরও একবার বুঝিয়ে দিল কর্ণাটকের এই সাম্প্রতিক বিতর্ক।