নিউ ইয়র্কে দুষ্কৃতীর হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার পর প্রথমবার মুখ খুললেন সলমন রুশদি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও অকুতোভয় বুকারজয়ী লেখক। হামলা এবং হামলার পরে তাঁর পরিস্থিতি, সবকিছু নিয়েই রসিকতা করতে ছাড়লেন না তিনি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
তাঁর কণ্ঠরোধ করার জন্যেই তো এত আয়োজন। তাও আজ থেকে নয়, ৩৪ বছর ধরেই জারি সেই ধারাবাহিক আক্রমণ। কিন্তু কোনও ফতোয়াই যে কোনও দিনই অক্ষরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, নিজের গোটা জীবন ধরে যেন সে কথাই লিখে চলেছেন সলমন রুশদি। দুষ্কৃতীর ছুরির আঘাত সয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে আরও একবার, এই ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে দাঁড়ালেন তিনি। আর সব মৌলবাদকে উপেক্ষা করে দিনের আলো দেখল রুশদির নতুন বই। ঘটনাচক্রে যার শিরোনামেই রয়ে গিয়েছে ‘বিজয়’ শব্দটি। ‘ভিকট্রি সিটি’ নামে এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ভারত। আর এই বই প্রকাশের দিনেই, হামলার ছ-মাস পর ফের মুখ খুললেন পঁচাত্তর-পেরোনো লেখক। হামলার ঘটনায় এক চোখে দৃষ্টি হারিয়েছেন তিনি। তবু মার্কিন পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ‘কেমন আছেন’ এই প্রশ্নের জবাবে রুশদি হেসে বললেন, ‘যা হয়েছে, তারপরেও ভালই আছি।’ আর এই কথাতেই যেন স্পর্ধিত অবজ্ঞায় তিনি বুঝিয়ে দিলেন, মৌলবাদের সামনে মাথা নোয়াবে না তাঁর কলম।
আরও শুনুন: ছদ্মনামে আত্মগোপন, মৌলবাদী ফতোয়ায় অন্তত ৫৬ বার বাড়ি বদল করেছিলেন রুশদি
প্রায় পাঁচ দশক ধরে সাহিত্যের সঙ্গে বসত পেতেছেন রুশদি। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’, সম্মানিত হয়েছিল বুকার পুরস্কারে। তবে, রুশদিকে বিতর্কিত করে তোলে তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ইসলামিক দেশগুলি। দাবি ছিল, এই উপন্যাসে হজরত মহম্মদকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা ইসলামের পক্ষে অবমাননাকর। রুশদির বিরুদ্ধে ওঠে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ। ১৯৮৯ সালে রুশদির মাথার দাবিতে ফতোয়া জারি করে ইরানের তৎকালীন শাসক আয়াতোল্লা খোমেইনি। সেই থেকে প্রায় রাতারাতি জীবন পালটে যায় বুকারজয়ী ঔপন্যাসিকের। জানা যায়, ফতোয়া জারির প্রথম ছ-মাসের মধ্যেই অন্তত ৫৬ বার নিজের আশ্রয়স্থল বদল করতে হয়েছিল রুশদিকে। ১৯৯৩ সালে খোমেইনি পুনরায় এই ফতোয়ার কথা ঘোষণা করে। ফলত আত্মগোপনের জীবনই যেন শিরোধার্য হয়ে গিয়েছিল রুশদির ক্ষেত্রে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর লেখারা দিনের আলো দেখেছে। আস্তে আস্তে আলোয় ফিরেছেন রুশদি নিজেও। বক্তৃতা দিয়েছেন, বেড়াতে গিয়েছেন, পাঠকদের মুখোমুখি হয়েছেন, এমনকি বিয়েও করেছেন আবার। তাঁর কথায়, “লোকে আমার সঙ্গে মিশতে ভয় পেত। তাই আমি ভেবেছিলাম, সেই ভয় ভাঙানোর একটাই উপায় আছে। আর তা হল, আমি ভয় পাইনি এ কথা জানানো।”
আরও শুনুন: মণিপুর থেকে কান… কেন নগ্নতাকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তোলেন নারীরা?
যদিও ভয় পেয়েছিলেন রুশদির অনুরাগীরা। আর সে ভয় যে অমূলক ছিল না, খোমেইনির মৃত্যুর এতদিন পরেও রুশদির উপরে হওয়া হামলা তা বুঝিয়ে দিল। হামলাকারীর ছুরির আঘাতে এক চোখে দৃষ্টি হারিয়েছেন বর্ষীয়ান লেখক। মার্কিন পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর এক চোখে কালো চশমা পরা ছবি। তারপরে নিজের সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় সেলফি পোস্ট করে ফের রসিকতা জুড়লেন রুশদি। লিখলেন, “পত্রিকার ছবিটি নাটকীয় ও জোরালো বটে, তবে আসলে কিন্তু আমাকে এইরকম দেখতে।” তাঁর জীবনের থেকে তাঁর বই বেশি চমকপ্রদ হোক, এমনটাই তিনি চেয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন রুশদি। আর তারপরেই সরস ভঙ্গিতে তাঁর আক্ষেপ, “কিন্তু দুনিয়া সে কথা শুনলে তো!”
রুশদি আসলে নিজেও জানেন, দুনিয়া তাঁর কথা শুনতে চায়। তাই তাঁর উপর হামলার পর গোটা বিশ্বের সংস্কৃতিজগতে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। সেই বিপুলসংখ্যক অনুরাগীকে আশ্বস্ত করে ফের জীবনে ফিরলেন সলমন রুশদি। আর মৌলবাদের অবদমনের সামনে আরও একবার, প্রতিস্পর্ধা হয়ে জেগে উঠল তাঁর নাম।