সরস্বতী পুজো। শুধুমাত্র পড়ুয়াদের নয়, যে কোনও বয়সের বাঙালির কাছেই এই দিন উদযাপনের। বয়সের সঙ্গে সেই উদযাপনের রকমফের বদলালেও আনন্দের মাত্রাটা একইরকম থাকে। তবে এত আনন্দের মাঝেও কিছু নিয়ম মেনে চলতে ভুল করে না কেউই। যেমন সরস্বতী পুজোর দিন হলুদ জামাকাপড় পরা, পুজোর দিন একবারের জন্যেও বই খাতা না-ছোঁয়া, কিংবা পুজো শেষ হওয়ার আগে কুল না-খাওয়া। কীভাবে জন্ম হল এইসব নিয়মের? আসুন শুনে নিই।
তিনি বিদ্যার দেবী। পড়ুয়াদের কাছে তিনি পরম আরাধ্যা। একইসঙ্গে যাঁরা সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা সকলেই দেবীর কৃপাপ্রার্থী। মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথি তাঁর পুজোর দিন। যদিও অনেকের কাছে এই দিনটি বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। স্বাভাবিক ভাবেই দেবীর পুজোয় ধরা পড়ে বসন্তের ছোঁয়া। যার মধ্যে প্রথমেই উঠে আসে পলাশ ফুলের কথা। বসন্তকালীন এই ফুল নাকি দেবীর বিশেষ প্রিয়। পাশাপাশি অনেক মূর্তিতেই দেবীর পরনে থাকে বাসন্তী রঙের শাড়ি। তাই অনেকেই সরস্বতী পুজোর দিন হলুদ জামাকাপড় পরেন। যদিও শাস্ত্রমতে দেবীর প্রিয় রং সাদা। দেবীর ধ্যান মন্ত্র অনুযায়ী তাঁর গাত্র বর্ণ থেকে আরম্ভ করে সবই শ্বেতশুভ্র। তবু বসন্তের উৎসব হিসেবে এর সঙ্গে বাসন্তী রঙের যোগ নেহাতই কম নয়।
আরও শুনুন: বইপত্র ছোঁয়া ‘মানা’, অথচ সরস্বতী পুজোর দিনই কেন হয় হাতেখড়ি?
এরপর আসা যাক কুল খাওয়ার প্রসঙ্গে। শাস্ত্রের দিক দিয়ে দেখতে গেলে এই পুজোয় বিশেষ করে কোনও কিছুই খাওয়ায় নিষেধ নেই। যেহেতু দেবীর পুজোয় অন্যতম প্রধান আরাধ্য হিসেবে শালগ্রাম শিলা রাখা হয় তাই দেবীর পুজোয় কেবলমাত্র নিষিদ্ধ হল আমিষ দ্রব্য। তবে কুল খাওয়ায় নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণের হদিশ মেলে। বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখলে, সরস্বতী পুজো যে সময়টায় হয় তা মোটেও কুল পাকার সময় নয়। তাই পাকার আগেই যাতে কেউ কুল না খেয়ে ফেলে সেই অছিলায় এমন নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি কাঁচা কুল খেলে হজমের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তাই অনেকে এই সময় কুল খেতে নিষেধ করেন। তবে যে কোনও নিয়মের নেপথ্যেই একটি করে পৌরাণিক গল্প থাকে, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় না। সরস্বতী পুজোর আগে কুল না খাওয়া নিয়েও রয়েছে সেরকমই এক কাহিনি। পুরাণ মতে, দেবী সরস্বতীকে তুষ্ট করার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব কঠোর তপস্যা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই তপস্যার আগে দেবী স্বয়ং ব্যাসদেবকে একটি শর্ত দেন। তাঁর আশ্রমে একটি কুলের বীজ রেখে দেবী বলেন, এই কুলবীজ থেকে যেদিন গাছ হবে, এবং সেই গাছের কুল পাকার পর যদি ব্যাসদেবের মাথায় পড়ে, সেদিনই তাঁর তপস্যা সম্পূর্ণ হবে। ব্যাসদেবও বিনা বাক্যব্যয়ে সেই শর্ত মেনে নিয়ে তপস্যা শুরু করেন। কয়েক দিন পর সেই কুল বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা জন্মায়। ধীরে ধীরে সেই চারা বড় হতে থাকে। কয়েকবছর পর তা পূর্ণ মহীরূহে পরিণত হয়। একসময় সেই গাছে নতুন কুল হয় এবং একদিন তা পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পড়ে। বলা হয়, সে দিনটিই নাকি ছিল শুক্লা পঞ্চমীর দিন। এই দিনেই ব্যাসদেব বুঝতে পারেন তাঁর তপস্যা সম্পূর্ণ হয়েছে। আসন ছেড়ে উঠে তিনি সেই কুল দেবীকে নিবেদন করে বেদপাঠ আরম্ভ করেন। এই ঘটনার কথা মাথায় রেখেই সরস্বতীকে অর্পণ না করে কুল খেতে নেই বলেই মনে করেন অনেকে।
আরও শুনুন: নারায়ণ পুজোয় দিতেই হয় তুলসী পাতা, নেপথ্যে পুরাণের কোন গল্প?
এছাড়াও সরস্বতী পুজোর দিন আরও একটি নিয়মের বেশ চল রয়েছে। বিশেষ কিছু কারণে দিন লেখা-পড়া বা বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও কিছু ছুঁতে নেই। এদিন নিষ্ঠাভরে সকালে স্নান সেরে নিতে হয়। তারপর হলুদ জামাকাপড় পরে দেবীর সামনে যেতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর দেবীর পুষ্পাঞ্জলি হয়। পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে এই পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া বিশেষ প্রয়োজনীয়। এখানেই শেষ নয়। সরস্বতী পুজোর অন্যতম অঙ্গ হল ভোগ খাওয়া। সেখানেও যদিও খুচুড়িরই আধিক্য। বলা যায় এই দিনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে হলুদ রংটি। সেই ইঙ্গিত মেলে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত সরস্বতী মন্দিরেও। শাতাধিক প্রাচীন এই মন্দিরটির চূড়াও হলুদ রঙের। একইভাবে দেশের অন্যান্য প্রান্তে যেসব সরস্বতী মন্দির আছে সেখানেও দেবী গোটা হলুদ দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। তাই দেবীর আশীর্বাদ পেতে সরস্বতী পুজোর দিন এই কটি নিয়ম মেনে চলাই যথেষ্ট বলা চলে।