মহাযুদ্ধে মহামুকুট উঠেছে মহারাজ মাথাতেই। সমস্ত সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক, বিবাদ-প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্তব্ধ করে দিয়েছেন লিওনেল মেসি। শুধু একটা বিশ্বকাপ জয় নয়, যেন নিজের হাতে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় লিখেছেন মেসি। আর সে ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ ব্রাজিলীয় তারকা রোনাল্ডো নাজারিও। কী বলছেন তিনি? এদিকে, চিরকালীন সেই ‘গোট’ বিতর্ক নিয়েই বা কী মত ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর? আসুন শুনে নিই।
কেউ বলছেন শতাব্দীর সেরা ফাইনাল ম্যাচ। কেউবা বলছেন, সে তুলনায় না গিয়েও স্বীকার করে নিতে হয়, যা দেখা গেল তার তুলনা হয় না। এক জীবনে তা ভোলার মতো নয়। আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্সের বিশ্বকাপ ফাইনালের কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। চলছে চর্চা। কেউ বুঁদ হয়ে আছেন আনন্দে। কেউবা আপশোসে। কেউ আবার সবকিছু সরিয়ে রেখে শুধু ফিরে ফিরে বলে চলেছেন ম্যাচের স্মরণীয় মুহূর্তগুলির কথা। আর এই সকল চর্চার ভিতর যে মানুষটি মধ্যমণি, তিনি আর কেউ নন, লিওনেল মেসি। ফুটবলজীবনের একটি বৃত্ত যিনি সম্পূর্ণ করলেন বিশ্বকাপ স্পর্শ করে।
আরও শুনুন: খেলার টানে হাজির ১১ বিশ্বকাপে, গিনেস বুকে নাম ব্রাজিলীয় ফুটবলপ্রেমীর
আবেগ-উন্মাদনায় এবারের ফাইনাল যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, তার নজির বহু হাতড়েও পাচ্ছেন না অনেকে। হ্যাঁ বিশ্বকাপ মানেই অন্য কিছু। ক্লাব ফুটবলে কৌশলের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে তাত্ত্বিকরা মাথা ঘামান। বিশ্বকাপ মানে আসলে সারা বিশ্ববাসীর মনে লাগা মাতন। একটা মিথের জন্ম হওয়া। কিংবা কোনও মিথ ভেঙে যাওয়া। আশা-হতাশা, প্রাপ্ত-অপ্রাপ্তির ঘনঘন রং বদল। সেই নিরিখে বিশ্বকাপের সমতুল আর কিছু নেই। আর এবারের বিশ্বকাপকে প্রায় অন্য মাত্রা দান করেছিলেন মেসি নিজে। ফুটবলবিশ্বের এই শ্রেষ্ঠতম প্রতিভার অর্জনের বাকি বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। শুধু এই বিশ্বকাপই থেকে গিয়েছে অধরা মাধুরী হয়ে। দেশ আর দশের চাপ তিনি জানতেন। জানতেন নীল-সাদা জার্সিতে আর হয়তো বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলা হবে না। তাই শুরুতে পরাজয় এলেও, প্রতি ম্যাচে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছিলেন। বিশ্বকাপ যত এগিয়েছে, মেসি যত নিজেকে মেলে ধরেছেন সারা বিশ্বের সমর্থনের ভরকেন্দ্র গিয়েছে বদলে। দেশের সমর্থনের বিন্দুগুলি কবে যেন একটু একটু করে সরতে সরতে মিশে গিয়েছে মেসিতে। সেই মেসি যখন ফাইনালের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তখন, সারা পৃথিবীই যেন তাঁর হাতে বিশ্বকাপ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে একজন মানুষের জন্য এমন জনসমর্থন সচরাচর দেখা যায় না। মেসির বিশ্বকাপ প্রাপ্তির মুহূর্তে এই কথাটিই ফের মনে করিয়ে দিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি রোনাল্ডো নাজারিও।
আরও শুনুন: দুরন্ত দৌড় শুধু নয়, প্রতি ম্যাচে গড়ে ৪ কিমি হাঁটেন মেসি, কিন্তু কেন?
মেসিকে যে তাঁর ভাল লাগে, সে কথা গোপন করেননি তিনি। তবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথাও মাথায় রেখেছিলেন। আর তাই তিনি বলতে পারেননি যে, আর্জেন্টিনার জয়ে তিনি খুশি হবেন। বলেছিলেন যে, তিনি এতটাও হিপোক্রিট নন যে এই কথাটা অম্লানবদনে বলে ফেলবেন। যদিও তাঁরই দেশের অপর দুই তারকা, রিভাল্ডো এবং কাফু, মেসিকেই সমর্থন জানিয়েছিলেন। প্রায় একার দক্ষতায় মেসি যখন আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতালেন, তখন মেসিতে মন্ত্রমুগ্ধ হলেন রোনাল্ডো। বললেন, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার চির প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে মাথায় রেখেও বলতে হয়, এই মানুষটার খেলা সমস্ত বৈরিতাকে কোনায় ঠেলে দিতে পারে। ব্রাজিল এবং সারা ফুটবলবিশ্ব যেভাবে মেসির জন্য এক হয়েছে, তা দেখে সত্যিই তৃপ্ত এই কিংবদন্তি।
আরও শুনুন: জন্ম ব্রাজিলে, তবু মেসির জন্যই নগ্ন হওয়ার স্বপ্ন দেখেন এই মডেল
এই ফাইনালের পর ফুটবলবিশ্বে আরও একটা চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছ। গত এক-দেড় দশকের যে ‘গোট’ বিতর্ক, অর্থাৎ মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মধ্যে কে সর্বকালের সেরা, সেই তর্কেরও অবসান হল। পরিসংখ্যানের নিরিখে তো বটেই, এবং বিশ্বকাপ জয়ের পর রোনাল্ডোর থেকে যে অনেকটাই এগিয়ে গেলেন মেসি, এমনটাই মত অনেকের। একদিকে রোনাল্ডোর করুণ বিশ্বকাপ-সমাপ্তি, অন্যদিকে মেসির মাথায় গৌরবের মুকুট- এরপরেও কি তুলনা হয়? প্রশ্ন ফুটবলবিশ্বের। যদিও এ বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটিয়ে দিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো স্বয়ং। মেসির বিশ্বজয়ের আগেই তিনি বলে রেখেছিলেন, বিশ্বকাপ জয় এই তর্কে ইতি টানতে পারে না। নিজেকে দেখিয়ে বলেছিলেন, তিনি যদি বিশ্বকাপ জেতেনও, তাহলেও এই তর্ক শেষ হবে না। অর্থাৎ তাঁদের দুজনকে নিয়ে এই যে তুলনার খেলা, তাতে বিশ্বকাপ জয় যে বড় হয়ে দেখা দেবে না, এমনটাই মত ছিল সিআর সেভেনের।
বিতর্কের অবসান হোক বা না হোক, ফুটবলে মেসি-রোনাল্ডো যুগ প্রায় শেষের মুখে। পরের বিশ্বকাপে কি আবার তাঁদের দেখা যাবে? উত্তর জানা নেই। আর তাই আনন্দের মুহূর্তে মনখারাপের হালকা কুয়াশাও যেন ছড়িয়ে আছে ফুটবলপ্রেমীদের মনে।